সমলয় পদ্ধতিতে কম খরচে বেশি ফলন, দিন বদলের পথে পাহাড়ের কৃষি
কৃষকের শ্রম ও সময়ের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে এগিয়ে যাচ্ছে দেশের কৃষি ব্যবস্থা। ইতিমধ্যে দেশের বিভিন্ন জেলায় চাষাবাদের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে উন্নত কৃষি ব্যবস্থাপনা ও কৃষি প্রযুক্তি। কৃষিতে এমনই এক আশীর্বাদের নাম হলো ‘সমলয় চাষাবাদ পদ্ধতি’।
সারিবদ্ধভাবে ট্রেতে সাজানো ধানের কচি চারা, দেখতে অনেকটা সবুজ কার্পেটের মতো মনে মনে হলেও আসলে তা নয়। প্রচলিত পদ্ধতিতে বীজতলা তৈরি ও চারা রোপণ না করে এ পদ্ধতিতে প্লাস্টিকের ট্রেতে আধুনিক যন্ত্রের সাহায্যে লাগানো হয় ধানের বীজ। এতে ২০ থেকে ২৫ দিনের মধ্যে চারা মাঠে লাগানোর উপযোগী হয়ে যায়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, এ পদ্ধতিতে রাসায়নিক সারের ব্যবহার না করে সামান্য জৈব সারের ব্যবহারে খরচ কম হয়। প্লাস্টিকের ট্রে-তে বীজতলা করায় ধানের চারা উত্তোলন, রোপণ, ফসল মাড়াই ও সবই একযোগে করা যায়। উচ্চ ফলনশীল হাইব্রিড জাতের ধানের বীজ ব্যবহার করায় ১৪০ থেকে ১৪৫ দিনের মধ্যে ফসল তোলা সম্ভব হয়। বাড়ানো, উৎপাদন খরচ কমানো ও কৃষি যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে ভরা মৌসুমে ধান কাটার সময় কৃষি শ্রমিকের সংকটের সমাধানই হলো সমলয় চাষাবাদ।
এ পদ্ধতিতে বিশেষ অটোমেটিক কৃষি যন্ত্রের মাধ্যমে ট্রে-তে চারা বপন করা হয়। ট্রে-তে চারা বপন যন্ত্রের ৩টি চেম্বার থাকে। প্রথম চেম্বারে মাটি দেওয়া হয়। মেশিনের মাধ্যমে মাটি সরাসরি ট্রেতে পড়ে। দ্বিতীয় চেম্বারে অঙ্কুরিত বীজ দেওয়া হয়। সেই বীজও মেশিনের মাধ্যমে সঠিক পরিমাণে ট্রেতে পড়ে। তৃতীয় চেম্বারে আবারও মাটি দেওয়া হয়। সেই মাটিও মেশিনের মাধ্যমে বীজসহ ট্রে-তে পড়ে বীজ ঢেকে দেয়।
এরপর ট্রেগুলো জমিতে সারিবদ্ধভাবে রাখা হয়। মাটি যেন শুকিয়ে না যায়, সেজন্য পানি স্প্রে করা হয়। শীতে চারার যেন ক্ষতি না হয়, সেজন্য পলিথিন দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। চারার উচ্চতা ৪ ইঞ্চি হলে বা চারার বয়স ২০ থেকে ২৫ দিন হলে তা জমিতে রোপণ করার উপযোগী হয়।
সময়ের সঙ্গে কৃষি প্রযুক্তির এই হাওয়া লেগেছে পাহাড়েও। বান্দরবান সদর উপজেলার রাজবিলা ইউনিয়নের, উদালবনিয়া এলাকার ৫০-৬০ জন পাহাড়ি কৃষক তাদের জমিতে চাষাবাদের জন্য এই পদ্ধতি গ্রহণ করেছেন। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বাস্তবায়নে ২৪-২৫ অর্থবছরে কৃষি পুনর্বাসন সহায়তায় রবি মৌসুমে বোরো ধানের চাষ করা হচ্ছে সমলয় চাষাবাদ পদ্ধতিতে। এই পদ্ধতিতে চাষাবাদের মাধ্যমে এই এলাকার কৃষকরা স্বপ্ন দেখছেন দিন বদলের।
উশৈসিং মারমা পিন্টু চট্টগ্রাম পোর্ট সিটি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি হতে এম.বি.এ শেষ করে চাকরির পেছনে না ঘুরে আত্মকর্মসংস্থানের পথ হিসেবে বেছে নিয়েছেন কৃষিকে। উদালবনিয়া এলাকায় অন্য কৃষকরা নিজের ৩ একর জমি যুক্ত করে সমলয় চাষাবাদে এগিয়ে এসেছেন।
তিনি বলেন, জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও সিমিটের উদ্যোগে সমলয় চাষাবাদ পদ্ধতিতে ফসল ফলানোর কাজ চলছে। এই উদ্যোগে আমরা অনেক উপকৃত হয়েছি। আমার ৩ একর জমি। বর্তমানে জমিতে চাষাবাদের ক্ষেত্রে শ্রমিক স্বল্পতার কারণে সমলয় চাষাবাদে মেশিনের মাধ্যমে জমিতে ধানের চারা রোপণ করেছি। শ্রমিক খরচ ও সময় সাশ্রয় হয়েছে। এতে আমাদের অনেক উপকার হয়েছে।
আরেকজন কৃষক বলেন, আগে জমিতে চাষাবাদের জন্য শ্রমিক নিতে সময় ও খরচ বেশি লাগতো। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে সরকারি ধানের বীজ, সার দিয়েছে, এখন মেশিনের মাধ্যমে এক ঘণ্টায় ১ কানি জমিতে একজন শ্রমিক চারা রোপণ করে দিচ্ছে। তাই সব দিক দিয়ে আমরা খুশি।
কম সময়ে নিজের জমিতে ধানের চারা রোপণ করতে পারায় একই এলাকার ৫০ একর জমি দিয়ে সমলয় চাষাবাদে যুক্ত হয়েছে অনেক কৃষক।
গত ৭ জানুয়ারি বান্দরবান জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর উদালবনিয়া এলাকার ৫০-৬০ জন কৃষকের ৬০ একর জমিতে সমবায় ভিত্তিক চাষাবাদের কর্মসূচি ‘সমলয় চাষাবাদ’ উদ্বোধন করেন।
এ সময় সমলয় চাষাবাদে প্রায় ৬০ জন কৃষককে মাঠ পর্যায়ে বীজতলা তৈরিসহ জমিতে রাইস ট্রান্সপ্লান্টার মেশিনের মাধ্যমে ধানের চারা রোপণের বিভিন্ন কৌশল সম্পর্কে প্রশিক্ষণও প্রদান করা হয়।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্যমতে, এ বছর মোট ১১২৪১ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন জাতের ধান চাষ হয়েছে। উন্নত কৃষি প্রযুক্তির ব্যবহারে কৃষকদের শ্রম ও সময়ের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে আগামীতে জেলায় কৃষি কাজে ব্যবহৃত জমির পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে বান্দরবান জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক এম এম শাহ নেওয়াজ বলেন, কৃষি পুর্নবাসনের আওতায় দুইটি ব্লক প্রদর্শনী পেয়েছি। এরই ধারাবাহিকতায় সদর উপজেলা এবং আলীকদম উপজেলায় সমবায় ভিত্তিক সমলয় চাষাবাদের উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। এ এলাকায় ৫০ জন কৃষকের ৫০-৭০ একর জমি আছে। সরকারের উদ্দেশ্য কৃষকদের সমবায় ভিত্তিক চাষাবাদের চর্চা করানোর মাধ্যমে দলীয়ভাবে কাজ করার মনোভাব তৈরি করা।
প্রথম পর্যায়ে উচ্চ ফলনশীল ব্রি ধান ৯২ ধানের চারা কৃষকদের মাঝে প্রদান করা হয়েছে, এ জন্য ৪৫০০ ট্রে তে ধানের বীজতলা তৈরি করা হয়েছে যা রাইস ট্রান্সপ্লান্টার মেশিনের মাধ্যমে জমিতে রোপণ এবং কম্বাইম হারভেস্ট মেশিনের মাধ্যমে জমির ধান কর্তন করা হবে। প্রথম পর্যায়ে এ কর্মসূচির আওতায় জমিতে বীজ, সার, চারা রোপণ এবং ধান কর্তনের সম্পূর্ণ ব্যয় সরকারিভাবে বহন করা হবে। জমিতে সার প্রয়োগ, আগাছা ও পরিচর্যা কৃষকরা দলীয়ভাবে করবে। এর মাধ্যমে উপসি জাতের ধানের ফলন বাড়বে এবং কৃষকদের মাঝে দলীয়ভাবে কাজ করার মাধ্যমে সমবায় ভিত্তিক কার্যক্রম গড়ে তোলাই আমাদের মূল উদ্দেশ্য।
শহীদুল ইসলাম/আরকে