হৃদয়ের লাশের হদিস না মিললেও জামিনে মুক্ত অভিযুক্ত পুলিশ সদস্য
টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার আলমনগর গ্রামের কৃষক লাল মিয়া এবং রেহানা বেগমের একমাত্র সন্তান হৃদয় (১৮)। অভাবের সংসারে বাবাকে আর্থিকভাবে সহযোগিতা করতে হৃদয় গাজীপুরে এসে অটোরিকশা চালাতেন।
পরিবারের দাবি, আন্দোলনের সময় হাসিনা সরকারের পতনের পর গত ৫ আগস্ট গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে বিজয় মিছিল চলাকালে পুলিশের সঙ্গে জনতার সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে হৃদয় নিহত হন।
গত ৫ আগস্টের এক ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা যায়, ওইদিন কোনাবাড়ীর প্রধান সড়কে ৮ থেকে ৯ জন পুলিশ সদস্য একজন হৃদয়কে বেধড়ক মারধর করছে। একপর্যায়ে এক পুলিশ সদস্য খুব কাছ থেকে তাকে গুলি করে। এরপর পুলিশ সদস্যরা ঘটনাস্থল ত্যাগ করে এবং যুবকটি কিছুক্ষণ ছটফট করে নিস্তেজ হয়ে পড়েন।
হৃদয়ের ভগ্নিপতি ইব্রাহিম হোসেন বলেন, হৃদয় হেমনগর ডিগ্রি কলেজে স্নাতক প্রথমবর্ষের ছাত্র ছিলেন। দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়া হৃদয়ের পক্ষে লেখাপড়ার খরচ চালানো সম্ভব ছিল না। হৃদয় বাধ্য হয়ে গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে একটি মেস থেকে ভাড়ায় ইজিবাইক চালিয়ে আয়-রোজগার করতেন এবং নিজের পড়াশোনার খরচের পাশাপাশি পরিবারের আর্থিক সহযোগিতা করতেন।
কোনাবাড়ীর গ্যারেজ মালিক হাফিজুর রহমান বলেন, হৃদয় তার গ্যারেজের ইজিবাইক ভাড়ায় চালাতো। গোলমালের সময় গ্যারেজে ইজিবাইক রেখে মেসে ফেরার পথে পুলিশের ধাওয়ায় সে দুই ভবনের মাঝখানে আশ্রয় নেয়, সেখান থেকে পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে যায়।
গত ৬ আগস্ট থেকেই গাজীপুরের বিভিন্ন হাসপাতালের মর্গে খুঁজেও হৃদয়ের লাশের সন্ধান পায়নি পরিবার। পরে ৭ আগস্ট থানায় গিয়ে কোনো পুলিশ সদস্যকে দেখতে পায়নি পরিবারের লোকজন।
৫ আগস্ট থেকে ১৬ আগস্ট পর্যন্ত পুলিশ শূন্য ছিল কোনাবাড়ী থানা। এতে গুলিতে নিহত হৃদয়ের লাশের সন্ধান পেতে বারবার থানায় গিয়েও কোনো পুলিশ সদস্যকে পায়নি পরিবার।
এর মধ্যে নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরে পুলিশে ব্যাপক রদবদল করা হয়। কোনাবাড়ী থানায় ৫ আগস্টের আগে কর্মরত পুলিশের অধিকাংশ সদস্যকেই অন্যত্র বদলি করা হয়। এতে হৃদয়ের মরদেহ কোথায় রাখা হয়- সেই প্রশ্নের উত্তর আজও পায়নি পরিবার।
এখনো ছেলের লাশের অপেক্ষায় পুলিশের কাছে ধরনা দিচ্ছেন হৃদয়ের পরিবার। হৃদয়ের মা রেহেনা বেগমের দাবি ছেলের হাড় হলেও যেন তাকে ফেরত দেওয়া হয়।
৫ আগস্ট বিকেল ৫টার দিকে পুলিশের প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যার ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়লে বিপাকে পড়ে পুলিশ। গুলি ছোড়া পুলিশ কনস্টেবল আকরামের নামও প্রকাশ্যে চলে আসে এসময়। পরে চাকরি থেকে পালিয়ে কনস্টেবল আকরাম হোসেন নিজ গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলার বরুহাতে চলে যান।
গত ৬ সেপ্টেম্বর আকরামকে তার গ্রামের বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে এই মামলার এজহারনামীয় আসামি দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। গ্রেপ্তারের পর মামলার অধিকতর তদন্তের জন্য আসামি আকরামের ১০ দিনের রিমান্ড চায় পুলিশ। তবে তাকে এক দিনের রিমান্ড মুঞ্জুর করা হয়েছিল।
সবাইকে অবাক করে দিয়ে গত ২৩ ডিসেম্বর গাজীপুর দায়রা জজ আদালতের অবকাশকালীন বিচারক প্রধান অভিযুক্ত আকরামকে জামিন দেন। রাতেই কারাগার থেকে বেরিয়ে যান আকরাম।
এদিকে মামলার প্রধান অভিযুক্ত আকরাম হোসেন জামিন পাওয়ায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া চলে গাজীপুরজুড়ে। রোববার (৫ জানুয়ারি) সকাল ১০টার দিকে জামিনের ঘটনায় বিচারকের অপসারণ দাবি করে আদালত প্রাঙ্গণে বিক্ষোভ করে স্থানীয় বিভিন্ন সংগঠন।
গাজীপুর আদালতের পিপি মোস্তফা কামাল ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, আদালতকে ভুল তথ্য দিয়ে গত ২৩ ডিসেম্বর অবকাশকালীন বেঞ্চ থেকে প্রকৃত ঘটনা আড়াল করে আকরাম জামিন নিয়ে বেরিয়ে যান। সঙ্গত কারণে সে সময় আমি উপস্থিত ছিলাম না। পরে ঘটনা জানতে পেরে রোববার আদালতে জামিন বাতিলের মিস কেস করি। শুনানিতে আদালতে প্রকৃত ঘটনার ভিডিও উপস্থাপন করি। বিস্তারিত শুনানির পর জেলা দায়রা জজ আদালতের বিজ্ঞ বিচারক শামীমা আফরোজ অভিযুক্ত আকরামের জামিন বাতিল করে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন।
এদিকে হৃদয় হত্যার ঘটনায় ২৬ আগস্ট কোনাবাড়ী থানায় হত্যা মামলা করেন হৃদয়ের ফুফাতো ভাই মো. ইব্রাহিম।
মামলার তদন্তের দায়িত্ব পান কোনাবাড়ী থানার উপ-পুলিশ পরিদর্শক উৎপল কুমার সাহা। জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, আমি দায়িত্ব পাওয়ার পরে হৃদয়ের লাশ অনেক খুঁজেছি। গাজীপুরের প্রায় প্রতিটি কবরস্থানে এবং হাসপাতালের ডাটা সংগ্রহ করেছি। তবে হৃদয়ের মরদেহের কোনো সন্ধান পাইনি। পরে মামলাটি থানা থেকে সরিয়ে মহানগর ডিবিকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ডিবি কি তদন্ত করেছে তা আমার জানা নেই। আমি প্রধান আসামিকে গ্রেপ্তার করেছি। শুনেছি সে আদালত থেকে জামিন পেয়ে বেরিয়ে গেছে। জামিন দেওয়া আদালতের বিষয়। কীভাবে জামিন হলো, তা আদালতই ভালো বলতে পারবেন।
তবে আসামির জামিনের বিষয়ে মহানগর ডিবি পুলিশের এ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পরিদর্শক ইব্রাহীম বলেন, জামিনের বিষয়ে অফিসিয়ালভাবে আমরা কিছুই জানি না। পুরো বিষয়টি আদালতের এখতিয়ার, তবে আমরা মামলার তদন্ত করছি।
শিহাব খান/আরকে