স্রোতের সুতোয় বাঁধা তারেক মাঝির জীবন
সময় কারও জন্য থেমে থাকে না। নদীর স্রোতের মতোই সময় বয়ে যায়। এই সময় আর স্রোতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে জীবন কাটিয়ে দিচ্ছেন বাগেরহাটের রামপালের কালিগঞ্জ নদীর খেয়াঘাটের মাঝি তারেক সুলতান। তার নৌকার বৈঠায় আঁকা জীবনের নানা রং, নানা গল্প।
৫৫ বছর বয়সী তারেক সুলতান পেশায় একজন খেয়া মাঝি। প্রতিদিন ভোরে নৌকা নিয়ে হাজির হন কালিগঞ্জ খেয়াঘাটে। তার নৌকা পারাপারে নির্ভরশীল এলাকার অসংখ্য মানুষ। স্থানীয় স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রী থেকে শুরু করে পেশাজীবী মানুষ সবার জীবনের একটি অংশ হয়ে উঠেছেন তিনি।
তারেক মাঝি বললেন, তিন যুগ ধরে এই নদীতে খেয়া দিয়ে মানুষ পার করছি। প্রতিজনের কাছ থেকে পাঁচ টাকা করে নেই। দিনে কখনো ৩০০ টাকা হয়, আবার কখনো ৫০০ টাকাও হয়। এই নদীর পানি, বাতাস, আর মানুষের হাসি-কান্না আমার জীবনের সঙ্গী।
পরিবারের কথা বলতে গিয়ে তার চোখে ফুটে ওঠে মমতা। তিনি বলেন, ‘আমার দুই ছেলে, এক মেয়ে আর বৃদ্ধ মা আছেন। মেয়েকে মেট্রিক পাস করিয়ে দুই বছর আগে বিয়ে দিয়েছি। বড় ছেলে অনার্সে আর ছোট ছেলে ক্লাস নাইনে পড়ে। সংসারের এই ব্যয়ভার আমি কীভাবে চালাচ্ছি, সেটা শুধু আমিই জানি।’
তবে সময় বদলেছে, বদলেছে মানুষের জীবনধারা। ‘আগে নৌকায় যাত্রীরা গল্প করত, হাসি-তামাশা করত। এখন সবাই ব্যস্ত মোবাইলে। কিন্তু নদীর স্রোত ঠিক আগের মতোই আছে,’ বলেন তারেক মাঝি।
যাত্রাপুরের খেয়া মাঝি বাচ্চু শেখের কথাও আলাদা কিছু নয়। প্রায় ৩০ বছর ধরে নৌকা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন তিনি। তবে আক্ষেপের সুরে বলেন, আমরা অনেক বছর ধরে এই কাজ করছি, কিন্তু সরকারের কাছ থেকে কোনো সহায়তা পাইনি। নদী আমাদের ভালোবাসা, কিন্তু জীবিকা অর্জনের জন্য সরকারি সহায়তা খুব দরকার।
রামপালের মাঝি শাহজাহান বলেন, নদীর ওপর নির্ভর করেই আমাদের জীবন। আমাদের জন্য তেমন কোনো সরকারি সহায়তা নেই। খেয়াঘাটের উন্নয়ন হলে আমরা আরও ভালোভাবে সেবা দিতে পারতাম।
তারেক আর বাচ্চু মাঝি অনেকের সংগ্রামী জীবনের প্রতিচ্ছবি। নদীর স্রোত তাদের শিখিয়েছে জীবনের পথে বাঁধা-বিপত্তি পেরিয়ে সাহসের সঙ্গে এগিয়ে চলার শিক্ষা। তাদের নৌকার বৈঠায় আঁকা হয়ে আছে এক সাধারণ মানুষের অসাধারণ জীবনের গল্প।
অন্যদিকে, স্থানীয় স্কুল শিক্ষক সেলিম আহমেদ বলেন, মাঝিরা শুধু জীবনধারণের জন্য কাজ করেন না, তাদের নিঃস্বার্থ প্রচেষ্টা থাকে এলাকার মানুষের উপকার করা। তাদের জন্য কিছু সরকারি সুবিধা দরকার, যাতে তারা আরও ভালো জীবনযাপন করতে পারে।
নৌকা পারাপার হওয়া যাত্রী রুবিনা বেগম বলেন, তারেক মাঝি খুব ভালো মানুষ। অনেক বছর ধরেই তাকে চিনি। তবে নৌকায় উঠতে-বসতে অনেক সময় সমস্যায় পড়তে হয়। ঘাটগুলো উন্নত হলে সবার জন্য সুবিধা হতো।
রামপালের সুশীল সমাজের সদস্য ও শিক্ষক আব্দুল কাদের বলেন, নদী আমাদের সম্পদ। আর মাঝিরা এই সম্পদকে কাজে লাগিয়ে মানুষের জীবন সহজ করে তুলছেন। কিন্তু তাদের জীবনমান উন্নত করতে আমাদের স্থানীয় প্রশাসনকে আরও উদ্যোগী হতে হবে। বিশেষ করে খেয়াঘাটগুলোতে নিরাপত্তা ও উন্নয়ন জরুরি।
কালীগঞ্জের নদী থেকে শুরু করে রামপাল, মোংলা এবং বাগেরহাটের ভৈরব নদী পর্যন্ত বিস্তৃত জলপথে বেঁচে আছেন প্রায় তিন শতাধিক মাঝি। তারেক আর বাচ্চু মাঝি তাদের মধ্যে অন্যতম, যারা জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত নদীর স্রোতের সঙ্গে মিলিয়ে কাটিয়েছেন। নৌকার বৈঠার তালে তালে চলে তাদের জীবন। সবাই চান সরকারি সুযোগ-সুবিধা, কিন্তু এই মাঝিদের জীবনের গল্পগুলো যেন সেই স্রোতের মধ্যে হারিয়ে যায়।
শেখ আবু তালেব/আরকে