পদে পদে প্রতিবন্ধকতা বরগুনার শুঁটকি পল্লীর সম্ভাবনায়
প্রতিবছর শুকনো মৌসুমে বরগুনায় শুরু হয় শুঁটকির উৎপাদন। প্রায় পাঁচ মাস ধরে চলতে থাকা এ কাজে কর্মসংস্থান হয় বিভিন্ন জেলাসহ স্থানীয় কয়েক হাজার নারী-পুরুষের। বিশেষ করে বরগুনার তালতলী উপজেলার বিভিন্ন চরে অস্থায়ী ছোট-ছোট ঘর নির্মাণ করে দিনরাত কাজ করেন শ্রমিকরা। তবে পল্লীগুলোতে শ্রমিকদের জন্য পয়ঃনিষ্কাশন, সুপেয় পানির ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতায় বাধার মুখে পড়েছে শুঁটকি পল্লীর সম্ভাবনা। এ ছাড়াও অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার ফলে একদিকে বাড়ছে শুঁটকি উৎপাদন খরচ, অপরদিকে ভোগান্তি বাড়ছে ব্যবসায়ী ও পাইকারদের।
শীত মৌসুমের শুরুর দিকে নভেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত চলে শুঁটকি উৎপাদনের কাজ। এ সময় দেশের বিভিন্ন জেলার শুঁটকি শ্রমিকরা পরিবারসহ বরগুনার তালতলীতে কাজ করতে আসেন। স্থানীয় শ্রমিকদের সঙ্গে উপজেলার আশারচর, সোনাকাটা, জয়ালভাঙ্গা ও ফকিরহাটসহ আরও কয়েকটি এলাকায় শুঁটকি উৎপাদনের কাজ করেন তারা। এ সময় দূর থেকে আসা শ্রমিকদের অস্থায়ী ছোট-ছোট ঘর তৈরি করে থাকতে হয় শুঁটকি পল্লীতে। প্রতিদিন সাগর ও নদীতে জেলেদের জালে ধরা পড়া রুপচাঁদা, ছুরি, কোরাল, সুরমা, লইট্টা, পোপাসহ প্রায় ২৫ প্রজাতির বিভিন্ন মাছ সংগ্রহের পর শুঁটকি পল্লীতে নিয়ে এলে রোদে শুকিয়ে শুঁটকি তৈরির কাজ করেন শ্রমিকরা। থাকা-খাওয়াসহ পল্লীতে পয়োনিষ্কাশনের ভালো ব্যবস্থা না থাকায় নানা ধরনের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে এখানকার শ্রমিকদের। বিশেষ করে স্থায়ী কোনো টয়লেটের ব্যবস্থা না থাকায় বেশি বিপাকে পড়েছেন নারী শ্রমিকরা।
সরেজমিনে তালতলীর ফকিরহাট নামক এলাকার একটি শুঁটকি পল্লী ঘুরে দেখা যায়, নদী ও সাগর থেকে ট্রলারে মাছ শিকার করে পল্লীতে নিয়ে আসেন জেলেরা। পরে মাছগুলো পরিষ্কার করে আকার ও প্রজাতি অনুযায়ী তা আলাদা করেন শ্রমিকরা। এরপর পানিতে ধুয়ে যে মাছগুলো মানুষের খাওয়ার জন্য শুঁটকি করা হবে তা বিশেষভাবে তৈরি মাচায় শুকানো হয়। এ ছাড়া যে মাছ দিয়ে গবাদিপশুর খাবার তৈরি করা হবে সেগুলো মাটিতে জালের ওপর শুকানো হয়। কিছুক্ষণ পরপরই সমানভাবে শুকাতে মাছগুলো নাড়িয়ে দেন শ্রমিকরা। কেউ কেউ আবার শুকিয়ে শুঁটকি হয়ে যাওয়া মাছগুলো মেপে বস্তায় ভরছেন। পরে ব্যবসায়ীদের থেকে চট্টগ্রাম, সৈয়দপুর, খুলনা, জামালপুরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় এসব শুঁটকি সরবরাহ করেন পাইকাররা। তালতলী থেকে পাইকারদের মাধ্যমে প্রতি সপ্তাহে গড়ে প্রায় ১৫০ মণ শুঁটকি সরবরাহ করা হয়। তবে যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রের সুবিধা বৃদ্ধি পেলে সরবরাহের পরিমাণ আরও বাড়বে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা।
শুঁটকি পল্লীতে দীর্ঘদিন ধরে শ্রমিকের কাজ করা মো. হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ বছর আমি আড়াই মাস হলো কাজ শুরু করেছি। বর্তমানে পল্লীতে মাছ সরবরাহ কম থাকায় এখন পর্যন্ত আমি কোনো বেতন নিতে পারিনি। শুঁটকির মৌসুম শেষ হলে আমরা ইলিশ শিকার করা জেলেদের সঙ্গে থাকি। বর্তমানে এই একটি পল্লীতে প্রায় দুই থেকে তিনশ শ্রমিক কাজ করেন। মাছের সরবরাহ কম থাকায় কাউকেই ঠিকভাবে পারিশ্রমিক দিতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা।
মো. ওমর ফারুক নামে আরেক শ্রমিক ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখানে যে শুঁটকি উৎপাদন করা হয় রাস্তাঘাট খারাপ থাকায় তা বাজারজাত করতে আমাদের সমস্যায় পড়তে হয়। ভাঙা ও কাঁচা রাস্তার কারণে যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ হওয়ায় পরিবহন খরচ অনেক বেশি দিতে হয়। ফলে মালিকের খরচ বেড়ে যায়। এখানকার যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো করা হলে মালিক লাভবান হবে, পাশাপাশি আমরাও সঠিক সময়ে আমাদের পারিশ্রমিক নিতে পারব।
একই শুঁটকি পল্লীতে কাজ করা পিয়ারা বেগম নামে এক নারী শ্রমিক ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি প্রায় ২৫ বছর ধরে এই শুঁটকি পল্লীতে কাজ করি। আমার স্বামী বর্তমানে অসুস্থ। নারী-পুরুষ এখানে সমানভাবে কাজ করলেও নারীদের জন্য বিশেষ প্রয়োজনে কোনো টয়লেটের ব্যবস্থা নেই। পুরুষরা তাদের প্রয়োজনে যে কোনো জায়গায় যেতে পারে কিন্তু আমরা নারীরা তা পারি না। টিউবওয়েলসহ এখানে যদি স্থায়ীভাবে টয়লেট নির্মাণ করে দেওয়া হয় তাহলে আমাদের জন্য সুবিধা হয়।
মো. শহিদুল ইসলাম নামে আরেক শ্রমিক ঢাকা পোস্টকে বলেন, শুঁটকি পল্লীতে কাজ শুরু হলে আমরা নারী-পুরুষ মিলে অসংখ্য শ্রমিক একত্রে কাজ করি। আমাদের সব থেকে বেশি সমস্যায় পড়তে হয় পানি এবং পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা না থাকায়। আমরা পুরুষরা যেকোনো জায়গায় কোনো রকম ব্যবস্থা করে চলতে পারলেও নারীদের ভোগান্তিতে পড়তে হয়। এ ছাড়া রাস্তাঘাট খারাপ হওয়ায় দীর্ঘ চার-পাঁচ মাস কাজ করার সময়ে কেউ যদি অসুস্থ হয় দ্রুত তাকে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়া সম্ভব হয় না। কাছাকাছি দোকান থেকে ওষুধ আনতে গেলেও প্রায় ২০০ টাকা ভাড়া দিয়ে যেতে হয়।
শুঁটকি ব্যবসায়ী মো. দুলাল ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি ৩০ বছর ধরে তালতলীতে শুঁটকির ব্যবসা করি। এখান থেকে শুঁটকি পরিবহনের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিশেষ করে রাস্তার অবস্থা খুবই খারাপ। ঠিকভাবে গাড়ি রাস্তা দিয়ে আসা-যাওয়া করতে পারে না। গাড়ি ভাড়াসহ অন্যসব মিলিয়ে তুলনামূলক আমাদের বেশি খরচ হয়। দুই-তিন বছর ধরে এ ব্যবসায় আমাদের এখন লোকসান হচ্ছে। এ ছাড়া এ বছর পল্লীতে শুঁটকি তৈরির মাছ সরবরাহ কম রয়েছে। তবে সামনে আরও দুই মাস সময় আছে, লাভ হবে নাকি লোকসান হবে তা এখনও জানি না।
এ বিষয়ে তালতলী উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) উম্মে সালমা ঢাকা পোস্টকে বলেন, বর্তমানে তালতলী থেকে যে পরিমাণ শুঁটকি সরবরাহ হয় আমরা চাই আরও বেশি পরিমাণ শুঁটকি এখান থেকে দেশের বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ হোক। শুঁটকি পল্লীতে আমি গিয়েছি এবং সেখানে কর্মরত নারীদের ফ্রি মেডিকেল সেবার ব্যবস্থা করেছি। এ ছাড়া শুঁটকি পল্লীতে যারা কাজ করেন তাদের বিভিন্ন সমস্যার বিষয়ে জেনেছি। তাদের সুবিধার্থে শুঁটকি পল্লীতে পাবলিক টয়লেট নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। সুপেয় পানির ব্যবস্থা করতে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের মাধ্যমে টিউবওয়েল স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। এ ছাড়া যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করতে গ্রামীণ অবকাঠামো অথবা এলজিইডির মাধ্যমে উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
এএমকে