সৎ নেতৃত্ব থেকে দেশ এখনো বঞ্চিত : জামায়াতের আমির
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, আল্লাহ আমাদের এই দেশ উপহার দিয়েছেন। সঙ্গে খনিজ সম্পদসহ অনেক কিছু দিয়েছেন। কিন্তু আমাদের একটা জায়গাতে ঘাটতি রয়ে গেছে। সৎ নেতৃত্ব থেকে দেশ এখনো বঞ্চিত রয়ে গেছে। এই জায়গাটা পূরণ না হলে আমাদের জাতি সত্যিকার অর্থে মর্যাদাপূর্ণ জাতিতে পরিণত হতে পারবে না।
শুক্রবার (২৭ ডিসেম্বর) যশোর জেলা ঈদগাহ মাঠে ঐতিহাসিক কর্মী সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন তিনি।
এদিন মঞ্চে উঠেই ডা. শফিকুর রহমান সামনে উপস্থিতিতে জনতাকে জিজ্ঞেস করেন, ৫ আগস্টের আগে কেমন ছিলেন? সমস্বরে সবাই জবাব দেন—ভালো ছিলাম না। তিনি যশোরবাসীর উদ্দেশে বলেন, ২৪ সালের ৫ আগস্টের আগে দুঃশাসন ও দুর্নীতিতে দেশকে ডুবিয়ে দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। এই দলটি যখনই ক্ষমতায় এসেছে, মানুষের ওপর প্রতিশোধ নিয়েছে। আওয়ামী লীগ আগের বারও জনগণের ওপর শোষণ-অত্যাচার করেছিল। কিন্তু এবারের অত্যাচার-জুলুম ছিল অন্য সময়ের চেয়ে বেশি। তাদের হেদায়াত কামনা করে তিনি বলেন, কেউ কল্পনাও করেনি ২০২৪ সালে ফ্যাসিবাদ শেষ হয়ে যাবে।
তিনি বলেন, দেশ স্বাধীন হয়েছে—এর প্রথম কৃতিত্ব মহান আল্লাহ তায়ালার। এরপর আমাদের গর্বের সন্তানদের। আমাদের সন্তানরা একটা দাবি নিয়ে রাস্তায় নেমেছিল। রংপুরে আমাদের এক সন্তান আবু সাইদ বুক চিতিয়ে বলেছিল ‘বুকের ভেতর তুমুল ঝর, বুক পেতেছি গুলি কর’। মনে করেছিল গুলি করা হবে না। ন্যায়সংগত দাবিতে ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা জানিয়ে রাস্তায় নেমেছিল। ভেবেছিল তাকে পুলিশ গুলি করবে না। কিন্তু পুলিশ পর পর তিনটি গুলি করে শেষ করে দিয়েছিল।
জামায়াতে ইসলামীর আমির ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, যশোরে উন্নয়নের ছোঁয়া নাই। এটি কি বাংলাদেশের অংশ না? যদি তাই হয়, তাহলে তারা কেন তাদের ন্যায্য অধিকারটুকু পাচ্ছেন না যশোর একটি অন্যতম বঞ্চিত এলাকা। এটি নাগরিক উন্নয়নের প্রাণকেন্দ্র হওয়ার কথা। কিন্তু কেন উন্নয়ন নাই। মানুষের বিবেক যখন কাজ করে না। মানুষের মনে যখন আল্লাহর ভয় থাকে না, তখন ক্ষমতায় বসার আগে মানুষের পা ধরে ভোট চায় আর ক্ষমতায় বসে গেলে মানুষকে ভুলে যায়। তিনি বলেন, সুষম উন্নয়নের জন্য সুন্দর মন দরকার। তা না হলে বৈষম্য দূর করা সম্ভব না। যেখানেই যাই বৈষম্য দেখা যায়। সরকার বলেছিল উন্নয়নের রাজপথে। রোল মডেল। চুরি করে সমস্ত সম্পদ বাইরে নিয়েছে।
ডা. শফিকুর রহমান উল্লেখ করেন, আজ বাজারে আগুন। সিন্ডিকেট এখন হাতবদল হয়েছে। সরকার এখনো ভাঙতে পারেনি। একজন চাঁদাবাজ পালিয়েছে, আরেকজন চাঁদাবাজিতে লেগে গেছে। তিনি সামনের মানুষের কাছে প্রশ্ন রেখে বলেন, দেশ কি চাঁদাবাজমুক্ত হয়েছে? মাঠ থেকে সমস্বরে জবাব আসে ‘না’। এইসময়ে জামায়াতে ইসলামী বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জামায়াতের নেতাদের ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। কার্যালয়গুলো তালা দেওয়া হয়েছে। নিবন্ধন কেড়ে নিয়ে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে, লাখো মামলা। বিনয়ের সঙ্গে একটা কথা বলতেই হবে। যারা বুকের রক্ত দিয়ে আমাদের একটি স্বাধীন দেশ দিয়ে গেল তাদের রক্তের সঙ্গে যেন আমরা বেইমানি না করি। তারা বৈষম্যের বিরুদ্ধে, ঘুসখোরদের বিরুদ্ধে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে আওয়াজ দিয়েছে। এই কাজটি যদি করেন তাহলে ঘৃণিত হবেন, নিন্দিত হবেন। আমরা আমাদের সব সহকর্মীদের জানাই এসব কাজে কেউ হাত বাড়াবেন না। কেউ চাঁদাবাজ হবেন না। কেউ ফুটপাতের দখলদার হবেন না। মামলা দিয়ে নিরীহ মানুষকে হয়রানি করবেন না। এই কাজ কেউ করবেন না।
তিনি বলেন, আজকে শিক্ষার্থীরা মাস্টার্স-ডিগ্রী সার্টিফিকেট নিয়ে দ্বারে দ্বারে ঘোরে। কাজ পায় না। তার একটা কারণ একটা গোষ্ঠীর বাংলাদেশকে তাদের জমিদারি মনে করতো। তাদের আনুগত্য ছাড়া এ দেশে কারো কোনো অধিকার ছিল না। এখন তারা বিদায় নিয়েছে। এখন তো আর এরকম থাকা উচিত নয়। কিন্তু এ দেশে শিক্ষার ব্যবস্থা নাই। ইনশাআল্লাহ আমরা এমন একটা শিক্ষাব্যবস্থা করবো, শিক্ষার্থী কেবল সার্টিফিকেট নিয়ে বের হবে না। কাজ হাতে তুলে দেওয়া তবে। আমরা জাতিকে আর বিশৃঙ্খলায় পড়তে দেবো না।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এমন একটা রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখে, যে রাষ্ট্রে আকাশ-পাতাল ব্যবধান থাকবে না নাগরিকদের মধ্যে। কেউ গাছ তলা আবার কেউ ২০ তলায় থাকবে না। বিচার বিভাগকে মেরুদন্ড সোজা করে দেওয়া হবে; যাতে রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকেও দ্বিতীয় চোখে না দেখে একই চোখে দেখে। বিচার যদি কায়েম হয় তাহলে কাউকে অধিকার চাইতে হবে না। চাঁদাবাজ দখলদার ঘুষ অফিস আদালত বৈষম্য দূর করা হবে। মানবিক বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদ, সম্রোজ্যবাদ থাকবে না। এখানে কোনো সংখ্যালঘু নাই। ধর্ম নিয়ে বিভাজন-বিভেদ চলবে না। নারীরা অধিকার সম্মান পেয়ে বলবেন আমি এই দেশের গর্বিত মা।
তিনি উপস্থিত জনতাকে সুন্দর দেশ গড়ার অঙ্গীকার করে জামায়াতে ইসলামীর আমির বলেন, এমন রাষ্ট্র গঠনে আপনাদের হাত মজবুত করতে হবে। দিল শক্ত করতে হবে। কদম চালু করতে হবে। দৃষ্টি প্রসারিত করতে হবে। দুঃশাসনমুক্ত দেশ গঠনে কাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখবেন, প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে ডা. শফিকুর রহমান বলেন, আপনাদের দিকে মানুষ তাকিয়ে আছে। আপনাদের পারতেই হবে। আমরা যদি দেশের জন্য কাজ করি তাহলে আপনাদের ভালোবাসা চাইবো, সমর্থন এবং সহযোগিতা চাইবো। জাতীয় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমরা যেন আপনাদেরও পাশে পাই।
যশোর জেলা আমির অধ্যাপক গোলাম রসুলের সভাপতিত্বে ও জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মাওলানা আবু জাফর ও সহকারী সম্পাদক অধ্যাপক গোলাম কুদ্দুসের যৌথ সঞ্চালনায় বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য মো. মোবারক হোসেন, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য মুহাদ্দিস আবদুল খালেক ও মাওলানা আজিজুর রহমান। সংগীত পরিবেশন করে যশোর জেলা সাংস্কৃতিক সংসদ।
অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন, কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরার সদস্য ড. আবদুল মতিন, ড. আলমগীর বিশ্বাস, ঝিনাইদহ জেলা আমির অধ্যাপক আলী আযম, চুয়াডাঙ্গা জেলা আমির অ্যাডভোকেট রুহুল আমীন, মাগুরা জেলা আমির এমবি বাকের, নড়াইল জেলা আমির আতাউর রহমান বাচচু, সাতক্ষীরা জেলা আমির, অধ্যাপক শহিদুল ইসলাম। ডা. মোসলেহ উদ্দীন ফরিদ, শহীদ আব্দুল্লার বাবা আব্দুল জব্বার, যশোর জেলার নায়েবে আমির মাওলানা হাবিবুর রহমান, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সহকারী সেক্রেটারি ড. আবদুল মান্নান, যশোর জেলা কর্মপরিষদ সদস্য অ্যাডভোকেট গাজী এনামুল হক, মাওলানা আরশাদুল আলম, কেশব উপজেলা আমির অধ্যাপক মুক্তার আলী, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আব্দুল কাদের জেলা শহর শিবির সভাপতি মোস্তফা কামাল প্রমুখ।
এর আগে আব্দুল্লাহ আল মামুনের অর্থসহ কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে কর্মী সম্মেলনের সূচনা হয়। শহীদ আব্দুল্লাহর বাবা আবদুল জব্বার বলেন, আমার ছেলে ঢাকায় গুলি খেয়ে ১০০ দিন পর মারা গেছে। তিনি জামায়াতের কাছে দাবি করেন, তার ছেলের রক্তের বিনিময়ে এই দেশে যেন আল্লাহর বিধান কায়েম হয়। ভারত থেকে নিয়ে এসে যেন শেখ হাসিনার বিচার করা হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি বলেন, সরকারি আইন মানতে গিয়ে যেন কোনো মানুষকে হত্যা করা না হয়। প্রয়োজনে বাড়ি ফিরে যাও।
কর্মী সম্মেলন শুরুর আগেই সম্মেলনস্থলে ভরে যায় মানুষে। দুপুরের দিকে জানা যায়, মাঠের বাইরে কয়েক কিলোমিটারজুড়ে মানুষে মানুষে সয়লাব হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর পর নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে মুখরিত হয় পুরো যশোর শহর।
এদিন সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক গোলাম রসুল বলেন, নতুন বাংলাদেশ গড়ার জন্য যশোরের আপামর জনতা জামায়াতের সঙ্গেই রয়েছে।
এ্যান্টনি দাস অপু/এএমকে