অবহেলা ও অসচেতনতায় মগড়া নদী যেন ময়লার ভাগার
দখল ও দূষণের কারণে এক সময়ের খরস্রোতা মগড়া নদী এখন নালায় পরিণত হয়েছে। সাধারণ মানুষের অবহেলায় ও অসচেতনতায় এ নদী যেন এক ময়লার ভাগার। ময়লা-আবর্জনার স্তুপ জমে মগড়ার এখন মরণদশা।
পাশাপাশি নাব্যতা সংকট ও দূষণের কারণে জলজ জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে। মাছের প্রজননের ক্ষেত্রে সংকট তৈরি করেছে এ দূষণ ও নাব্যতা।
অসংখ্য নদী, খাল-বিল হাওর বেষ্টিত নেত্রকোণার অন্যতম একটি নদীর নাম মগড়া। পুরো শহরকে সর্পিল আকারে ঘিরে থাকা এ নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল আজকের জেলা শহর নেত্রকোণা। এক সময় উত্তাল মগড়া নদীর ওপর দিয়ে চলাচল করত অসংখ্য পালতোলা নৌকা ও লঞ্চ। জেলার ভাটি অঞ্চলের মানুষের যাতায়াত, ব্যবসা-বাণিজ্য চলত এ নদীপথেই। কালের আবর্তে ও খননের অভাবে নদীটি এখন নাব্যতা সংকটের চূড়ান্ত পর্যায়ে।
বাংলাদেশে পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, মগড়া নদীটির দৈর্ঘ্য ১১২ কিলোমিটার। এর মধ্যে নেত্রকোণা শহরের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে প্রায় ৫ কিলোমিটার। মূলত শহরের অংশেই যে যেভাবে পারছে প্রতিদিন গৃহস্থলীর ময়লা ও বিভিন্ন ধরনের বর্জ্য ফেলছে নদীতে। এতে করে যেন ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে বেশ কিছু এলাকার নদীর। পাশাপাশি বাসা বাড়ির পয়ঃনিষ্কাশনের ময়লা পানিও পড়ছে নদীতে।
যে স্থানগুলোতে ময়লা ফেলা হয় তার আশপাশে যারা বসবাস করেন তারা বলছেন, ময়লার দুর্গন্ধে বসবাস করাই দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাশাপাশি মাছির উপদ্রব থাকায় ছোট বাচ্চারা বেশিরভাগ সময় ভুগছে বিভিন্ন অসুখে।
পৌর শহরের নাগড়া এলাকার বাসিন্দা রোকেয়া আক্তার বলেন, এখানে ময়লা ফেলার কারণে অনেক রোগ জীবাণু ছড়ায়। আমার বাসায় মাছির উপদ্রবে থাকতে পারি না। সারাক্ষণ ময়লা ফেলার কারণে মাছি ভনভন করে। মশা-মাছির ওষুধ ছিটালেও কাজ হয় না। আমার একটা ছোট বাচ্চা আছে সে প্রায় সময়ই বিভিন্ন অসুখে আক্রান্ত থাকে। সর্দি-জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্ট এ ধরনের সমস্যা লেগেই আছে আমার পরিবারে। এখানে যে পরিমাণ ময়লা ফেলে তার দুর্গন্ধে বাসায় বসবাস কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। পৌরসভা থেকে মাঝে মাঝে এসে একটু পরিষ্কার করে, কিন্তু সেটা পর্যাপ্ত না। মানুষ দিনের পর দিন এখানে ময়লা ফেলেই যাচ্ছে। আর ময়লা দিয়ে নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে।
আরও পড়ুন
সদরের কাটলী এলাকার বাসিন্দা মনিরা আক্তার বলেন, সবাই নদীতে ময়লা ফেলার কারণে আমরা এখন আর নদীতে গোসল করতে পারি না। অনেক সময় নদীর পানি দিয়ে আমাদের রান্নার কাজ করতে হয়। কিন্তু ময়লা ফেলার কারণে এখন আর নদীর পানি দিয়ে কোনো কাজ করতে পারি না। যে যেভাবে পারছে নদীতে ময়লা ফেলছে। বাসা বাড়ির ময়লা ফেলার পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের জীবজন্তু মারা গেলে নদীতে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। এতে করে নদীর পানি নষ্ট হয়ে গেছে। এখন আর নদীর পানি ব্যবহার করা যায় না। এই নদী একসময় অনেক বড় ছিল, আমরা দেখেছি বড় বড় নৌকা এ নদী দিয়ে গিয়েছে। আর এখন তো ফাল্গুন চৈত্র মাসে এ নদীতে পানিই থাকে না।
সদরের সাকুয়া এলাকার বাসিন্দা নুরু উদ্দিন বলেন, নদীতে নাব্যতা সংকটের কারণে এখন মাছ নেই বললেই চলে। ছোট বেলায় এমন মাছ ছিল যে গামছা দিয়ে মাছ ধরতে পারতাম এ নদীতে। আর এখন নদীতে শীতের সময় ক্রিকেট মাঠ হয়ে যায়। কয়দিন পরেই বাচ্চারা এখানে ক্রিকেট খেলবে। সে হিসেবে এই নদী বিলুপ্তপ্রায় অবস্থায় আছে। নদীটি যেন আবার নতুন করে খনন করা হয় সরকারের পক্ষ থেকে। তাহলে আমরা জনগণ এই নদীর সুফল আবার ভোগ করতে পারব।
বাংলাদেশে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সারওয়ার জাহান ঢাকা পোস্টকে বলেন, মগরা নদীটি জেলা শহরের মধ্য দিয়ে সর্পিল আকারে প্রবাহিত হয়েছে। এই নদীটির মোট দৈর্ঘ্য ১১২ কিলোমিটার। এর মধ্যে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার শহরের মধ্যে পড়েছে। যেটি শহরকে একটি অপরূপ সৌন্দর্য দান করেছে। কিন্তু দীর্ঘদিন যাবৎ এই নদীটা খনন না করা ও দূষিত হওয়ার কারণে নদীর যে স্বাভাবিক বৈচিত্র সেটা হারিয়েছে। আমরা পানি উন্নয়ন বোর্ড চেষ্টা করছি এই নদীটিকে কিভাবে তার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়।
সারওয়ার জাহান আরও বলেন, আমরা ইতোমধ্যে একটি খনন প্রকল্প বাস্তবায়ন করার চিন্তা-ভাবনা করছি। পাশাপাশি এই নদীটাকে যেন শহরের অংশে যে দূষণটা হচ্ছে সেটা থেকে রক্ষা করা যায় এবং নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে আনা যায় তার চেষ্ঠা করছি। পাশাপাশি নদীর যে জীববৈচিত্র্য সেটা রক্ষা করার জন্য আমরা বিভিন্ন ধরনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। এর মধ্যে আমরা কয়েক দফা জেলা প্রশাসন এবং নদী রক্ষা কমিশন কমিটিতে আলোচনা করেছি। আমরা আশা করছি খুব অল্প সময়ের মধ্যেই একটি প্রকল্প প্রণয়ন করতে পারব, যার মাধ্যমে আমরা নদীটাকে রক্ষা করতে পারব।
তিনি আরও বলেন, সম্ভাব্য সমীক্ষা যাচাইয়ের জন্য ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে পরামর্শ প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করা হবে। তাদের প্রতিবেদন অনুযায়ী পরবর্তীতে খননের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হবে। আমরা আশা করছি নদীটি তখন তার আগের অবস্থায় ফিরে আসবে।
নেত্রকোণা পৌরসভার পৌর নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ ফারুক ওয়াহিদ বলেন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার এই কাজটি পৌরসভার একটি ধারাবাহিক কাজ। আমরা পৌরসভা থেকে ওয়ার্ড কমিটি, স্থায়ী কমিটির সদস্য এবং সংশ্লিষ্ট কাউন্সিলর যারা ছিলেন, তাদেরকে দিয়ে চেষ্টা করেছি এগুলো দেখভাল করার। কিন্তু কাজটি শতভাগ করতে পারিনি এটা সত্যি। আমরা বিভিন্ন জায়গায় সচেতনতার জন্য সাইনবোর্ড ও ব্যানার দিয়ে সবাইকে সচেতন করার চেষ্টা করেছি, কিন্তু কোন ফলাফল আসেনি। আমাদের নেত্রকোণাতে পরিবেশ অধিদপ্তরের যিনি সহকারী পরিচালক আছেন, উনার সঙ্গে আমার কয়েকবার কথা হয়েছে। কয়েকটি স্থানও আমরা পরিদর্শন করেছি। কিন্তু আমরা এখন পর্যন্ত সন্তোষজনক পর্যায়ে যেতে পারেনি। আমাদের পৌরসভায় ৯টি ওয়ার্ডে কিছু প্রাইভেট কোম্পানি বাড়ি বাড়ি থেকে ময়লা সংগ্রহ করে। তাদের নির্দিষ্ট জায়গায় ময়লা রাখার জন্য বলা হয়েছে। কিন্তু তারা এই নির্দেশনা ঠিকঠাক বলছেন না। যার কারণে বিভিন্ন জায়গায় ময়লার কারণে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে।
চয়ন দেবনাথ মুন্না/আরকে