ঝিনাইদহে দুই কৃষকের কলা-ভুট্টা-পান নষ্ট করল দুর্বৃত্তরা
‘পরম যত্নে সার ও মাটি দিয়ে এক বছর ধরে লালনপালন করে বড় করেছি। ১৫ থেকে ২০ দিন পরেই বাজারে বিক্রয় করতাম। অথচ সকালে মাঠে আসতেই দেখি আমার সারা বছরের সব স্বপ্ন শেষ। রাতের আঁধারে শত্রুতা করে কলাগাছ থেকে সব অপরিপক্ব কলা কেটে মাটিতে ফেলে গেছে। এখন আমি কী করব?’
দুর্বৃত্তরা রাতের আঁধারে দুই কৃষকের কলা, ভুট্টা ও পানের লতা কেটে দেওয়ায় এভাবেই এক কলা এবং এক পানচাষি আর্তনাদ করছিলেন। বুধবার (১৮ ডিসেম্বর) দিবাগত রাতে সদর উপজেলার রাধাকান্তপুর গ্রামের মাঠে বেনজির আহমেদ শিলুর ২৫০টি কলার কাঁদি, দুই শতক ভুট্টা গাছ ও প্রতিবেশী টুলুর ৬ শতক জমির পান গাছের লাতা কেটে রেখে গেছে দুর্বৃত্তরা। এই ঘটনার পর থেকে ওই মাঠের কৃষকদের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
কৃষক বেনজির আহমেদ শিলু ঝিনাইদহ সদর উপজেলার ৫নং কুমড়াবাড়ীয়া ইউনিয়নের রাধাকান্তপুর গ্রামের হেলাল মালিতার ছেলে ও টুলু একই গ্রামের আজিমউদ্দীনের ছেলে। তাদের দুজনের দাবি, গ্রামের কিছু মানুষের সঙ্গে তাদের পূর্বশত্রুতা রয়েছে। প্রকাশ্যে তাদের কোনো ক্ষতি করতে না পেরে রাতের আঁধারে ফসলের এমন ক্ষতি করা হয়েছে।
রাধাকান্তপুর গ্রামের মাঠে গিয়ে দেখা যায়, নবগঙ্গা নদীর তীরে শিলুর দুই বিঘা জমিতে কলা, তার পশেই ভুট্টাখেত। কলাগাছ থেকে অপরিপক্ব কলা কেটে মাটিতে ফেলে রাখা হয়েছে। তার পাশেই দুই শতক ভুট্টা গাছের গোড়া থেকে কেটে ফেলা হয়েছে। মাঠের অপর প্রান্তে টুলুর ১২ শতক পান বরজের মধ্যে ৬ শতক জমির পান গাছের গোড়া থেকে লতা কেটে রাখা। এতে দুই কৃষকের প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকার ক্ষতি হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। মাঠের কৃষকদের থেকে জানা যায়, এর আগেও ওই মাঠে বিভিন্ন সময়ে কৃষকের ফসলের ক্ষতি হয়েছে।
প্রতিবেশী কৃষক কামরুল ঢাকা পোস্টকে জানান, একই মাঠে তার কলা ও ভুট্টার চাষ আছে। সকালে মাঠে এসে দেখেন শিলুর কলাগাছ থেকে কলা কেটে মাটিতে ফেলে রেখে গেছে দুর্বৃত্তরা। কলাখেতের পাশেই ভুট্টাখেত, সেখানেও দুই শতক জমির ভুট্টা গাছ কেটে রেখে গেছে। এই মাঠের সব কৃষকেরা অসহায়, সবাই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। যারা এই কাজের সঙ্গে জড়িত তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার দাবি জানান তিনি।
প্রতিবেশী সেলিক ঢাকা পোস্টকে জানান, গ্রামের দুই কৃষকের ২৫০টি কলা, দুই শতক ভুট্টা ও ৬ শতক জমির পান গাছ রাতের আঁধারে কে বা কারা কেটে দিয়ে গেছে। এটা খুবই দুঃখজনক।
পানচাষি টুলু ঢাকা পোস্টকে বলেন, এনজিও থেকে দেড় লাখ টাকা ঋণ নিয়ে এই পান বরজ দিয়েছি। প্রথম বছরেই পানের আবাদ ভালো হয়েছে। এই পানের ওপর এখন সংসার এবং এনজিও কিস্তির টাকা আসে। সকালে বরজে কাজ করতে এসে দেখি পান গাছের গোড়া থেকে সব লতা এক ফুট, দুই ফুট করে কাটা। গ্রামের কিছু মানুষের সঙ্গে আমাদের ঝামেলা রয়েছে। আমাদের ধারণা, হয়ত তারা প্রকাশ্যে কোনো ক্ষতি করতে না পেরে রাতের আঁধারে পানের গাছ কেটে দিয়ে গেছে। আমরা চাই তদন্ত করে আসল দোষীকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হোক।
কলাচাষি বেনজির আহমেদ শিলু ঢাকা পোস্টকে বলেন, কিছু কলা বিক্রয় উপযোগী হওয়ায় গতকাল বিক্রয় করেছি। সকালে ব্যাপারীর কলা কাটতে আসার কথা, এজন্য আমিও আসি কলা দেখতে, যেন অপরিপক্ব কলা না কাটে। বাগানে আসতেই দেখি, গাছ থেকে কলা কেটে কে বা কারা মাটিতে ফেলে রেখে গেছে। প্রতিটি গাছের মাথা থেকে কলা কাঁদিসহ কেটে ফেলে রাখা। আবার পাশেই ভুট্টাখেত সেখানেও দুই শতক জমির ভুট্টা গাছ কাটা।
তিনি আরও বলেন, আমার চাচাতো ভাইয়ের সঙ্গে গ্রামের কিছু মানুষের বিরোধ আছে। কিছুদিন আগেও তাকে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করেছে। তারা বিভিন্ন সময় হুমকিধমকি দিয়ে আসছে। আমাদের ধারণা তারাই শত্রুতা করে কলা ও ভুট্টা গাছ কেটে দিয়েছে। আমি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে দাবি, সঠিক তদন্ত করে দোষীদের শাস্তির আওতায় আনা হোক। এ কাজের সঙ্গে যেই থাকুক সঠিক বিচার চাই।
ঝিনাইদহ সদর উপজেলার কৃষি অফিসার মো. নূর-এ-নবী ঢাকা পোস্টকে বলেন, রাধাকান্তপুর গ্রামের দুইজন কৃষক শিলু ও টুলু ভাই। দুর্বৃত্তরা কৃষক শিলুর দেড় বিঘা জমির ফলন্ত কলার কাঁদি কেটে ফেলে রেখে গেছে, যেটা অপরিপক্ব। বাজারে বিক্রয় করারও কোনো সুযোগ নেই। উনার ৪০০ কলাগাছের মধ্যে ২৫০টি গাছের কলা কেটে নিচে ফেলেছে এবং বাকি অর্ধেক নষ্ট করে রেখে গেছে। অপর পান চাষি টুলুর ৬ কাঠা জমির পান বরজের মধ্যে ৩ কাঠা পানের লতা কেটে দিয়েছে। দুইজন কৃষক ভাইয়ের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। আমাদের কৃষি অফিস থেকে প্রণোদনার মাধ্যমে তাদের সহযোগিতা করার চেষ্টা করা হবে। পাশাপাশি স্থানীয় প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসন সঙ্গে কথা বলে তাদের যদি কিছু ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা যায় সেটাও চেষ্টা করা হবে।
তিনি আরও বলেন, একজন কৃষক এত কষ্ট করে নিজের সন্তানের মতো করে লালনপালন করে একটি গাছ বড় করে। একজন মানুষ কীভাবে কৃষকের এমন ক্ষতি করতে পারে! আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যারা আছেন, তাদের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই, তারা যেন এই কৃষক ভাইদের পাশে দাঁড়ায় এবং অন্যায়কারীদের শাস্তির আওতায় আনে।
আব্দুল্লাহ আল মামুন/এমজেইউ