যে কারণে শীতের জেলা পঞ্চগড়
ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে শীতের জেলা বলা হয় দেশের সর্বউত্তরের জেলা পঞ্চগড়কে। ভারত ও নেপাল দুই প্রতিবেশী দেশ জেলাটির নিকটস্থ থাকায় এ জেলা থেকে দেখা মেলে পৃথিবীর সুউচ্চ দুই পর্বতমালা হিমালয়-কাঞ্চনজঙ্ঘা। সেই হিমালয়ের বিধৌত অঞ্চলে জেলাটি অবস্থান হওয়ায় ‘হিমালয়কন্যা’ নামে সর্বাধিক পরিচিতি পেয়েছে। প্রতি বছর অক্টোবর-নভেম্বর মাসে মেঘমুক্ত আকাশে এ অঞ্চল থেকে দেখা মেলে হিমালয়ের যুগল পর্বতশৃঙ্গ বরফের পাহাড় কাঞ্চনজঙ্ঘা।
মানচিত্রের সর্ব উত্তরের কোণেই তেঁতুলিয়ার অবস্থান। মানচিত্রের কোণেই অবস্থিত দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসা-বাণিজ্য ও পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভাবনার চারদেশীয় স্থলবন্দর বাংলাবান্ধা। বাংলাবান্ধা জিরোপয়েন্ট থেকে ভারতের শিলিগুড়ির দূরত্ব মাত্র ১০ কিলোমিটার। আর এখান থেকেই আকাশ পথে কাঞ্চনজঙ্ঘার দূরত্ব ১১ কিলোমিটার, ভারতের দার্জিলিংয়ের দূরত্ব ৫৮ কিলোমিটার, নেপালের দূরত্ব মাত্র ৬১ কিলোমিটার, এভারেস্ট শৃঙ্গের দূরত্ব ৭৫ কিলোমিটার, ভুটানের দূরত্ব ৬৪ কিলোমিটার, চীনের দূরত্ব ২০০ কিলোমিটার। এ স্থান থেকে হিমালয়-কাঞ্চনজঙ্ঘার দূরত্ব নিকটস্থ থাকার কারণেই বয়ে আসা পাহাড়ি হিমেল হাওয়ায় শীতকালে বেড়ে যায় শীতের পারদ।
আবহাওয়াবিদরা বলছেন, উত্তর গোলার্ধ থেকে আসা শীত বাংলাদেশ বা এ অঞ্চলে সরাসরি ঢুকতে পারে না। হিমালয় থেকে আসা বায়ুর একটি অংশ কাশ্মীর, দিল্লি, উত্তর প্রদেশ, বিহার ও পশ্চিমবঙ্গের একাংশ হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। গরমের দিনে দিল্লির তাপমাত্রা ক্রমান্বয়ে কমতে কমতে বাংলাদেশে আসতে থাকে। আবার শীতকালে দিল্লির অতি শীত ধীরে ধীরে কমতে কমতে বাংলাদেশে আসে। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই দেশের মৌলভীবাজার ও চুয়াডাঙ্গা ও পঞ্চগড় এ তিনটি জেলায় শীত বেশি হয়ে থাকে। বিশেষ করে পঞ্চগড়ের উত্তরে খুবই কাছাকাছি দূরত্বে রয়েছে নেপালের হিমালয় পর্বতমালা ও মেঘালয়ের পাহাড়ি এলাকা। হিমালয়ে শীতকালে রীতিমতো বরফ পড়ে।
অপরদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ইদানীং বেশি শীত অনুভূত হচ্ছে বলে জানাচ্ছেন আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে বিশ্বের জলবায়ুর ধরনে পরিবর্তন ঘটার পাশাপাশি বদলে যাচ্ছে মহাসাগরীয় আবহাওয়ার আচরণও। ফলে তাপমাত্রার চরম ওঠানামা ঘটছে। বদলে যাচ্ছে ঋতু ও আবহাওয়ার সেই চিরচেনা বাক।
সম্প্রতি নেচার কমিউনিকেশন্স আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা যায়, আর্কটিক অঞ্চলের অস্বাভাবিক উষ্ণ তাপমাত্রার কারণে উত্তর গোলার্ধের অন্তর্গত দেশগুলোতে তীব্র শীত পড়তে পারে। আর বাংলাদেশ উত্তর গোলার্ধেরই দেশ। এ কারণে এবারের শীতের মাত্রা সামনে আরও বাড়তে পারে এমনটাই আশঙ্কা রয়েছে। চলমান শীত মৌসুমে অগ্রহায়ণের বিদায় লগ্নে টানা তিনদিন ১০ ডিগ্রির নিচে তাপমাত্রা রেকর্ড হওয়ায় মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বইছে এ জেলায়। আগামী সপ্তাহ নাগাদ শৈত্যপ্রবাহ আরও বিস্তার লাভ করতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অফিস। একইসঙ্গে জানুয়ারি মাসে তাপমাত্রা কমে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত নামতে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা।
পঞ্চগড়ের স্থানীয়রা জানায়, দেশের এ উত্তরের উপজেলায় বছরের গরমের তুলনায় শীতের আমেজ বেশি থাকে। আশ্বিনের ঝরা বৃষ্টি ও বাতাসে শুরু হয় শীতের আগমনি। কার্তিকেই শুরু হয় শীতের আমেজ। এ সময়টাতে উত্তরপশ্চিম দিকে মেঘমুক্ত আকাশে দৃশ্যমান হয়ে উঠে ভারত-নেপালের হিমালয়-কাঞ্চনজঙ্ঘা। সেই হিমালয়ের পাদদেশে জেলাটির অবস্থান। শীত পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর দিক থেকে ধেয়ে আসা হিমালয়ের বায়ুতে বাড়তে থাকে শীতের তীব্রতা। অগ্রহায়ণ থেকে ফাল্গুন পর্যন্ত শীত অনুভূত থাকলেও পৌষ আর মাঘ মাসে শীতের তীব্রতা বৃদ্ধি পায় এই দুই মাসে। রাত থেকে ভোর পর্যন্ত যেন জিরো ডিগ্রিতে নেমে আসে তাপমাত্রা। স্থানীয় আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের দেওয়া তথ্যে এ সময়টাতে তাপমাত্রা রেকর্ড হয়ে থাকে ১০ ডিগ্রি থেকে ৬ ডিগ্রিতে। ২০১৮ সালের ৮ জানুয়ারি তেঁতুলিয়ায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছিল ২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যা ছিল তেঁতুলিয়ার গত ৩০ বছরে দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা। এসব কারণেই শীতের জেলায় পরিণত হয়ে উঠেছে উত্তরের পঞ্চগড়।
পঞ্চগড়ের প্রথম শ্রেণির তেঁতুলিয়া আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের তথ্যমতে, গত ১৩ ডিসেম্বর থেকেই টানা চারদিন এ জেলার ওপর দিয়ে বইছে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ। তাপমাত্রা রেকর্ড হচ্ছে ১০ ডিগ্রির নিচে। ফলে শৈত্যপ্রবাহে প্রকট আকার ধারণ করেছে তীব্র শীত। শিশু থেকে আবাল বৃদ্ধবনিতা কাঁপছে এ তীব্র শীতে। তবে দিনের বেলায় রোদ থাকায় দিনে-রাতে তাপমাত্রা পরিবর্তনের কারণে বৃদ্ধি পেয়েছে শীতজনিত বিভিন্ন রোগব্যাধি। পর্যাপ্ত শীতবস্ত্রের অভাবে বিপাকে পড়েছে হতদরিদ্র থেকে নিম্ন আয়ের মানুষ। খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারনে চেষ্টা করছেন তারা।
জেলার প্রথম শ্রেণির তেঁতুলিয়া আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জিতেন্দ্রনাথ রায় ঢাকা পোস্টকে বলেন, সাধারণত শীতকালে বাতাসের স্বাভাবিক গতিবেগ ঘণ্টায় ৮ থেকে ১২ কিলোমিটার বা তারও বেশি হয়। কোনো অঞ্চলে দীর্ঘক্ষণ কুয়াশা পড়লে শীত বেশি হয়। কারণ সূর্যের আলো কুয়াশা ভেদ করে ভূপৃষ্ঠকে উত্তপ্ত করতে পারে না। ফলে ঠান্ডা বেশি অনুভূত হয়। গত চারদিন ধরে তাপমাত্রা রেকর্ড হচ্ছে ১০ ডিগ্রির নিচে। এ তাপমাত্রার রেকর্ডে বইছে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ। বিশেষ করে হিমালয় পর্বত কাছে থাকায় এ অঞ্চলে দেশের অন্যান্য জেলার আগে এখানে শীত আগে নামে।
এসকে দোয়েল/এসএম