মেহেরপুরে সারের কৃত্রিম সংকট, লাইনে দাঁড়িয়েও সার পাচ্ছেন না কৃষক
মেহেরপুরে গম, ভুট্টা, তামাক ও আলুর আবাদের ভরা মৌসুমে সার নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন কৃষকেরা। এক বস্তা সার সংগ্রহ করতেই চাষিদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। সার মিললেও বস্তাপ্রতি ক্ষেত্রবিশেষে গুনতে হচ্ছে অতিরিক্ত ৫০০ টাকা।
এদিকে ডিলারদের দাবি, একই কৃষক তাদের বিভিন্ন আত্মীয়ের নামে বার বার সার তুলছেন। যার ফলে সার দিতে একটু সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।
মেহেরপুরের বিভিন্ন গ্রামের সার ডিলারদের গুদামের সামনে সারের জন্য আইডি কার্ড হাতে কৃষকদের দীর্ঘ লাইন। কখন মিলবে সার এমন প্রতিক্ষায় ঠাঁই দাঁড়িয়ে কৃষক ও কৃষাণিরা। কেউ সার নিয়ে ফিরছেন বাড়ি, আবার অনেকেই ফিরছেন খালি হাতে। কৃষকদের অভিযোগ ডিলার ও সাব ডিলারদের অনিয়মের কারণে এবং ডিলাররা খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে বেশি দামে সার বিক্রির কারণে সারের এমন কৃত্রিম সংকট তৈরি হয়েছে।
তবে কৃষি বিভাগ বলছে, সারের কোনো সংকট নেই। কারখানায় সার উৎপাদনে কিছুটা দেরি হওয়ায় এমন সমস্যা হয়েছে। কয়েক দিনের মধ্যে সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে।
মেহেরপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, মেহেরপুর জেলার তিনটি উপজেলায় বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি কর্পোরেশন (বিসিআইসি) কর্তৃক অনুমোদিত সার ডিলার রয়েছেন ৩৫ জন এবং বাংলাদেশ এগ্রিকালচারাল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন (বিএডিসি) কর্তৃক অনুমোদিত সার ডিলার রয়েছেন ৬৮ জন। এসব ডিলারদের মধ্যে সদর উপজেলায় ১৩ জন, মুজিবনগর উপজেলায় ১০ জন এবং গাংনী উপজেলায় ১২ জন ডিলার রয়েছেন। এদের সঙ্গে কৃষকদের সারের সংকট কাটাতে শুধুমাত্র গাংনী উপজেলাতে বিএডিসি এবং বিসিআইসির সাব ডিলার রয়েছেন ১৫৪ জন। এসব ডিলার ও সাব ডিলাররা প্রতিবছর সার বরাদ্দ পাওয়া পান। তারা টিএসপি ১৫ হাজার ২৯৯ টন, ইউরিয়া ৩ হাজার ৬৩৭ টন, ডিএপি ১৪ হাজার ৮৬১ টন এবং পটাশ ১২ হাজার ৯৩৯ টন সার বরাদ্দ পান।
তবে ডিসেম্বর মাসের চাহিদায় টিএসপি ১ হাজার ৭৮১ টন, ডিএিপ ২ হাজার ৪৪২ টন, ইউরিয়া ৪ হাজার ৯৬৪ টন এবং পটাশিয়াম ২ হাজার ৮২৪ টন সার পাওয়া গেছে।
ইতোমধ্যে চলতি মাসের (ডিসেম্বর) সব সারই তুলেছেন সংশ্লিষ্ট ডিলাররা। ৫০ কেজির এক বস্তা ডিএপি সারের সরকারি মূল্য ১ হাজার ৫০ টাকা হলেও কৃষককে কিনতে হচ্ছে ১ হাজার ৪৫০ টাকা থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকায়। ৫০ কেজির এক বস্তা পটাশের সরকারি দাম ১ হাজার টাকা। কিন্তু চাষিদের কিনতে হচ্ছে ১ হাজার ৩০০ টাকা থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকায়।
এক বস্তা টিএসপির সরকারি দাম ১ হাজার ২৫০ টাকা। কিন্তু ডিলারদের নিকট থেকে সার না পেয়ে কৃষকদের বিভিন্ন দেকান থেকে কিনতে গুনতে হচ্ছে ১ হাজার ৬০০ টাকা পর্যন্ত। কৃষকদের প্রতি বস্তায় অতিরিক্ত গুনতে হচ্ছে ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা, ক্ষেত্র বিশেষে ৫০০ টাকা পর্যন্ত।
গাংনী উপজেলার সাহারবাটি ইউনিয়নের সার ডিলার শওকত ট্রেডার্সের সামনে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে কয়েকশ মানুষ সারের জন্য অপেক্ষা করছে। অনেক কৃষক অভিযোগে বলেন, আমরা দুদিন সার কিনতে এসে ফিরে গেছি। আজকে পাব কি না তা জানি না।
কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে কালো বাজারে বেশি দামে সার বিক্রির অভিযোগ উঠেছে অনুমোদিত বিসিআইসি ও বিএডিসি ডিলারদের বিরুদ্ধে। কৃষকদের অভিযোগ আাওয়ামী লীগ সরকারের সময় রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রয়োগ ও কৃষি কর্মকর্তাদের যোগসাজসে একই ব্যক্তিকে বিসিআইসি ও বিএডিসি ডিলার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। যার ফলে ডিলাররা দুই স্থান থেকে উত্তোলনকৃত সার অর্ধেক কৃষকদের দিচ্ছে আর অর্ধেক সার কালোবাজারে বিক্রি করছেন। কৃষকরা জানান, একই ব্যক্তিকে দুই প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স না দিয়ে পৃথক পৃথক ব্যক্তিকে ডিলার নিয়োগ করা হলে সারের জন্য হাহাকার তৈরি হতো না।
শুধু তাই নয়, মেহেরপুর গাংনী শহরের সার ব্যবসায়ী বিএডিসি ডিলার তরিকুল ইসলামের দোকানে সার ক্রয় করতে গিয়েও সার না পেয়ে বাড়ি ফিরতে হয়েছে অনেক কৃষককে। এছাড়া জেলা কৃষক লীগের কৃষি বিষয়ক সম্পাদক শহিদুল ইসলাম শাহ তার নিজের নামে ৪টি ডিলার নিয়োগ নিয়ে গাংনী উপজেলার চাষিদের মাঝে সার বিক্রয় না করে বেশি দামে অন্যজেলার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বেশি দামে সার বিক্রি করছেন বলেও কৃষকদের অভিযোগ।
এদিকে বিসিআইসি ডিলার সমিতির মেহেরপুর জেলা সভাপতি হাফিজুর রহমান হাপির রয়েছে হক এন্টারপ্রাইজ, সম্রাট এন্টারপ্রাইজ ও আকছেদ এন্টারপ্রাইজ নামে ৩টি ডিলারশিপ। পৃথক নামে হলেও সবই শহিদুলের।
জানা গেছে, অধিকাংশ ডিলার নামমাত্র সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নে ছোট একটি গোডাউন ভাড়ায় দেখালেও ব্যবসা পরিচালনা করেন গাংনী কিংবা বামন্দী বাজারে। বরাদ্দকৃত সার কোথায় বিক্রি হয় তা নিয়েও সন্দেহ কৃষকদের।
গাংনীর ষোলটাকা গ্রামের কৃষক ছামিদুল ইসলাম বলেন, ষোলটাকা ইউনিয়নের বিসিআইসি সার ডিলার গাংনী হাসপাতাল বাজারে ব্যবসা করে থাকে ইউনিয়নে তার কোন সারের ব্যবসা নেই।
বানিয়াপুকুর গ্রামের আবুল হোসেনের ছেলে আকবর জানান, ইউনিয়নে কোনো সার ডিলার না থাকায় ১০ কেজি সারের প্রয়োজন হলেও বাজারে সার কিনতে যেতে হয়।
বিসিআইসির সাব ডিলার তেরাইল গ্রামের আব্দুর রহিম বলেন, ডিসেম্বর মাসের বরাদ্দ প্রতি মাসে ১৩৮ ইউরিয়া, ৫৬ ডিএপি, ফসফেট ৪৯ বস্তা, পটাশ ৩০ বস্তা। এমন বরাদ্দকৃত সারে কৃষকের চাহিদা পূরুণ হচ্ছে না।
খুচরা ডিলার সভাপতি মো. শাহিনুল ইসলাম শাহিন বলেন, ১৪ মাস খুচরা ডিলাররা সার পায় না। তিনবার জেলা প্রশাসকের বরাবর আবেদন করেও কোনো প্রতিকার পাইনি। খুচরা ব্যবসায়ীদের সার না দিয়ে ডিলাররা সারের সংকট তৈরি করেছে।
বিসিআইসি ডিলার সমিতির মেহেরপুর জেলা সভাপতি হাফিজুর রহমান হাপি বলেন, কৃষকদের সার দেওয়ায় নিয়ে কোনো অনিয়ম হচ্ছে না। কৃষকরা একটু ধৈর্য্য ধরলে সবাই সার পাবেন।
মেহেরপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিজয় কৃষ্ণ হালদার বলেন, জেলায় চাহিদা অনুযায়ী সার পাচ্ছি। মেহেরপুর জেলায় প্রতিবছর এসময় কৃষকরা আলু,তামাক,তুলা,গম,ভুট্রার আবাদ করেন। যার ফলে সারের চাহিদা হঠাৎ বেড়ে গেছে। এছাড়া সার কারখানায় সার উৎপাদনেও কিছুটা ধীরগতি। তবে শিঘ্রই সমস্যা কেটে যাবে।
আকতারুজ্জামান/আরকে