দক্ষিণাঞ্চলে মোবাইল আসক্তিতে ২৫ শতাংশ শিশুর দৃষ্টিশক্তির ক্ষতি
ভোলার তজুমদ্দিন উপজেলার বড় মলংচড়া ইউনিয়নের বাসিন্দা জয়নাল ফকিরের পাঁচ বছরের ছেলে রিফাতকে নিয়ে এসেছেন বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। উপজেলায় কয়েকজন ডাক্তার দেখালেও আশানুরুপ উন্নতি না হওয়ায় বরিশালে নিয়ে এসেছেন।
জয়নাল ফকির বলেন, ‘ডাক্তার কইছে পোলাপানগো মোবাইল দ্যাখাইয়া চোখে ডিস্টার্ব বাজাইছি। করোনেরওতো কিচ্ছু নাই—এইটুকুন গুড়াগাড়ায় (ছেলেমেয়ে) মোবাইল চিইন্না হালাইছে (চিনে ফেলেছে)। মোবাইল না দেলে ভাত খায় না। মোবাইল দ্যাখতে দ্যাখতে ঘুমায়। এ্যাগোর হাঙ্গাদিন (সারাদিন) লাগবো মোবাইল মোবাইল।’
আলোচনায় যুক্ত করেন রিফাতের মা কুলসুম আক্তার, ‘চউখের পাওয়ার গ্যাছেগা। ডাক্তার কি কয় বুঝি না, হাঙ্গা দ্যাশের পোলাপাইন মোবাইল দ্যাখে। আর, পাওয়ার গ্যালো মোর পোলার?’
অবশ্য শুধু মোবাইল দেখায় শিশু রিফাতের দৃষ্টিশক্তি কমে যাচ্ছে—এটা বিশ্বাস করতে পারছে না কুলসুম আক্তার। তিনি প্রয়োজনে ঢাকায় আরও বড় হাসপাতালে নিতে চান সন্তানকে। বুধবার (১১ ডিসেম্বর) দুপুরে শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চক্ষু বর্হিবিভাগে কথা হয় এই পরিবারটির সঙ্গে।
মাত্রাতিরিক্ত সময় মোবাইল দেখায় শুধু যে শিশু রিফাতের দৃষ্টিশক্তি লোপ পেয়েছে তেমনই নয়—দক্ষিণাঞ্চলে ২৫ শতাংশ শিশু-কিশোরের দৃষ্টিশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মোবাইল আসক্তির কারণে বলে জানিয়েছেন শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চক্ষু বিভাগের প্রধান সহযোগী অধ্যাপক ডা. শফিকুল ইসলাম।
অভিভাবকদের উদাসিনতাকে দায়ী করে তিনি বলেন, ইদানিং মোবাইলে ভিডিও চালিয়ে শিশুদের খাবার খাওয়াতে দেখা যায়। শিশু-কিশোররা অভিমান, কান্না করলে তাকে মোবাইল চালাতে দিয়ে শান্ত রাখা হয়। গাড়িতে চলাচল কিংবা কোথাও বেড়াতে গেলেও একইভাবে শিশু-কিশোরদের সামলায়। এতে হয়তো সাময়িকভাবে সন্তানকে শান্ত রাখছেন কিন্তু সারা জীবনের জন্য ক্ষতি করছেন।
ডা. শফিকুল ইসলাম বলেন, মোবাইলের পর্দা ছোট হওয়ায় এরমধ্যে ছবি-ভিডিও ক্ষুদ্র দেখায়। যিনি মোবাইল দেখেন তাকে খুব কাছ থেকে দেখতে হয়। এতে চোখের কর্ণিয়া ও রেটিনায় মারাত্মক ক্ষতি হয়। এসব ক্ষতি স্থায়ী অন্ধত্বের কারণ হতে পারে।
শুধু যে মোবাইল সেটিই নয় নিয়ার ওয়ার্ক অর্থাৎ খুব কাছ থেকে যে কোনো কিছুর দিকে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকলে চোখ ক্ষতিগ্রস্থ হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, হাসপাতালে প্রতিদিন অসংখ্য শিশু-কিশোর রোগী চোখের সমস্যা নিয়ে আসছে। এদের কেসস্টাডি করে দেখেছি ২৫ শতাংশই মোবাইল দেখে চোখের ক্ষতি করছে। তা ছাড়া এখনকার প্রায় শিশুদের চশমা পড়তে হচ্ছে। তারা ছোটবেলা থেকে মোবাইল দেখে অভ্যস্ত হওয়ায় দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পায়।
মোবাইলে শিশুদের নিয়ার ওয়ার্ক করতে না দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি জানান, সাধারণত বয়স্করা চোখের রোগে আক্রান্ত হন। কয়েক বছর ধরে ১৮/২০ বছর পর্যন্ত বয়সীদের আক্রান্তের সংখ্যাও বেড়েছে উদ্বেগজনক হারে। শিশু-কিশোরদের মোবাইল স্ক্রিন থেকে যত দূরে রাখা যাবে তত সুরক্ষিত থাকবে তাদের চোখ।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, প্রতি বছর ১ লাখের বেশি রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে বহির্বিভাগে ও টেলিসেবা নিয়ে থাকেন। ওদিকে যুক্তরাজ্যের গবেষণা নির্ভর চিকিৎসা সাময়িকী ‘ব্রিটিশ জার্নাল অব অফথালমোলজি’তে দাবি করা হয়েছে ১৯৯০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে স্বল্পদৃষ্টিসম্পন্ন শিশুর সংখ্যা বেড়েছে তিনগুণ। শিশুদের দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হওয়ার প্রবণতার হার সবচেয়ে বেশি এশিয়া মহাদেশে।
সৈয়দ মেহেদী হাসান/এএমকে