বরগুনায় আলু বীজের সংকট, সিন্ডিকেট করে বেশি দামে বিক্রি
বরগুনায় আলু বীজের তীব্র সংকটে পড়েছেন বিভিন্ন এলাকার কৃষকরা। এমনকি অগ্রিম টাকা দিয়েও চাষের জন্য পর্যাপ্ত বীজ পাচ্ছেন না তারা। আর এ সংকটকে কাজে লাগিয়ে সরবরাহকারীরা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে অতিরিক্ত দামে আলু বীজ বিক্রি করছেন বলে অভিযোগ কৃষকদের। এ ছাড়াওু জেলায় কোনো কোল্ডস্টোরেজ না থাকায় আলু বীজ উৎপাদন করতে পারছেন না তারা। তবে এ সংকট নিরসনের পাশাপাশি সিন্ডিকেট ভাঙতে চেষ্টা চলমান আছে বলে দাবি কৃষি বিভাগ ও জেলা প্রশাসনের।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বরিশাল বিভাগের মধ্যে আলু চাষের দিক থেকে বরগুনার অবস্থান তৃতীয়। তুলনামূলক এ অঞ্চলে আলুর চাষ কিছুটা কম হলেও অনেকটা চাহিদা পূরণ হয় বরগুনায় উৎপাদিত আলুতে। এ ছাড়া প্রতি বছারই কৃষকদের আলুর ফলন ভালো হওয়ায় এ বছর বরগুনায় ৯৭৫ হেক্টর জমিতে আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে বরগুনা সদর উপজেলায় ১৪০, পাথরঘাটায় ৫৪০, বামনা ৩৫, বেতাগী ১২৮, আমতলী ৬২ ও তালতলীতে ৭০ হেক্টর জমিতে আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে জেলায় মোট ১ হাজার মেট্রিক টন আলু বীজের চাহিদা রয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত জেলায় মোট ১৫৯ হেক্টর জমিতে আলু আবাদ সম্পন্ন করেছেন কৃষকরা। কিন্তু বিপত্তির বিষয় হচ্ছে এ বছর বিভিন্ন কোম্পানির নির্ধারিত দামের থেকেও বেশি দামে কৃষকদের আলু বীজ কিনতে হচ্ছে। এতে আলু ক্ষেতের সার, ওষুধসহ সকল খরচ মিলে উৎপাদনের পর লাভ নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন বরগুনার বিভিন্ন এলাকার আলু চাষিরা।
সরেজমিনে বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার কালমেঘা ইউনিয়নের বিভিন্ন আলু চাষিদের খেত ঘুরে দেখা যায়, বর্তমানে খেত প্রস্তুতসহ বীজ বপনে ব্যস্ত সময় কাটছে আলু চাষিদের। নারী-পুরুষ একত্রে মিলে খেত প্রস্তুত করছেন। কেউ কেউ প্রস্তুতকৃত খেতে বপন করছেন আলু বীজ। গত বছর আলুতে লাভের পরিমাণ বেশি হওয়ায় এবং বাজারে দাম ভালো থাকায় এবার নতুন করে অনেক কৃষকই ঝুঁকেছেন আলু চাষে। তবে এ বছর চড়া দামে বীজ কিনে লোকসানের শঙ্কায়ও পড়েছেন কৃষকরা। তাদের অভিযোগ নির্ধারিত মূল্যের তুলনায় মণ প্রতি প্রায় ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত বেশি টাকায় আলু বীজ বিক্রি করছেন স্থানীয় সরবরাহকারীরা।
কালমেঘা এলাকার আলু চাষি মো. ইব্রাহিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ বছর আলুর বীজের দাম ব্যাপকহারে বাড়িয়ে বিক্রি করছেন স্থানীয় ডিলাররা। এ গ্রেড বীজ প্রতি বস্তা কোম্পানির মূল্য ৩ হাজার ৪৮০ টাকা এবং বি গ্রেড বীজ প্রতি বস্তা ৩ হাজার টাকা করে নির্ধারণ করা আছে। তবে ডিলারদের থেকে তা কিনতে হচ্ছে ৪ হাজার থেকে ৪ হাজার ৭০০ টাকায়। এতে প্রতি বস্তায় প্রায় ১ হাজার ২০০ টাকা বেশি খরচ করে কিনতে হচ্ছে আলু বীজ। এতে বাকি উৎপাদন খরচ ব্যয়ের পর এ বছর আলুতে আমাদের লোকসান হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
নয়া মিয়া হাওলাদার নামে একই এলাকার আরেক আলু চাষি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা জমি প্রস্তুত করার পর আলু বীজ সংগ্রহ করতে ডিলারের কাছে গিয়ে শুনি বীজ নেই। যা আছে তার দাম অনেক বেশি। আবার কম দামে যে বীজ পাওয়া যায় তার মান খারাপ হওয়ায় আলুর ভালো উৎপাদন হবে না। যেহেতু খেত প্রস্তুত করা হয়ে গেছে তাই বাধ্য হয়ে বেশি দামে বীজ কিনতে হচ্ছে আমাদের। তবে যে পরিমাণ খরচ হচ্ছে তাতে কেমন লাভ হবে তা নিয়েই এখন চিন্তায় আছি।
প্রস্তুতকৃত জমিতে চাহিদা অনুযায়ী আলুর বীজ না পেয়ে মো. মিজানুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা প্রতিবছরই আলু চাষ করি। তবে এ বছর বীজ সংকটের কারণে আমাদের সম্পূর্ণ জমিতে বীজ বপন সম্ভব হবে না। এছাড়া প্রতিবছরের তুলনায় এ বছর বীজের দাম অনেক বেশি।
আলু বীজ কিনতে সিন্ডিকেট অথবা আর কোনো ভোগান্তি রয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, জমি অনুযায়ী যে পরিমাণ বীজের প্রয়োজন তা আগেই সরবরাহকরীদের কাছে অগ্রিম টাকা দিয়ে বুকিং করা ছিল। কিন্তু এরপরও আমরা ওই পরিমাণ বীজ পাইনি। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে অন্য জায়গায় বেশি দাম পেয়ে বীজ আমাদেরকে না দিয়ে অন্য জায়গায় বিক্রি করে দিয়েছেন তারা।
ক্ষেতে বীজ বপন করতে থাকা খালেদা বেগম নামে একজন ঢাকা পোস্টকে বলেন, যে পরিমাণ আলুর বীজ পেয়েছি তাতে আমাদের কিছুই হবে না। সার, ওষুধ ও বদলা সব মিলিয়ে ক্ষেত প্রস্তুত করতে যে টাকা খরচ হয়েছে, এ বছর সে পরিমাণ লাভ হবে বলে মনে হয় না।
একই এলাকার মো. তরিকুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আলু বীজ নির্ধারিত দামের তুলনায় প্রায় ১ থেকে দেড় হাজার টাকা বেশি দামে অন্য জায়গায় বিক্রি করা হয়েছে। ফলে আমরা এখানকার চাষিরা উপযুক্ত টাকা অগ্রিম দিয়েও আলু বীজ পাইনি। অথচ ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দাম বাড়িয়ে বিক্রি করে লাভবান হয়েছেন।
স্থানীয় পর্যায়ে চাষিদের কাছে দাম বেশি রাখার বিষয়ে জানতে চাইলে কালমেঘা ইউনিয়নের আলু বীজ সরবরাহকারীরা অভিযোগের বিষয়টি অস্বীকার করেন। আলু বীজ সরবরাহকারীদের মধ্যে জাকির নামে এক ব্যবসায়ী ঢাকা পোস্টকে বলেন, যে পরিমাণ আলু বীজের চাহিদা রয়েছে তা কোম্পানি দিতে পারেনি। অনেক চাষিই টাকা নিয়ে আমার কাছে বীজ নিতে এসেছে, কিন্তু তাদেরকে বীজ দিতে পারিনি। যাদের থেকে টাকা নিয়েছি তাদেরকে কোম্পানির নির্ধারিত দামেই বীজ দিয়েছি। তবে রাজশাহী থেকে বিক্রির উদ্দেশ্যে বীজ এনে বেশি দামে বিক্রি করার কথা স্বীকার করেন তিনি। ওই সময় কৃষকদের কাছে দাম বাড়িয়ে বীজ বিক্রির অভিযোগে ভ্রাম্যমাণ আদালতে জরিমানা দিয়েছেন বলেও জানান তিনি।
অভিযোগের বিষয়ে আরেকজন আলু বীজ সরবরাহকারী মো. জাহাঙ্গীর ঢাকা পোস্টকে বলেন, বেশি দামে আমি বীজ বিক্রি করি না, যারা বিক্রি করে তাদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করেন। আমি বেশি বিক্রিও করিনি, মাত্র ১২ টন বীজ বিক্রি করেছি। আমি বিক্রি করলে আমাকে এসে ধরবেন। কোম্পানির দামের থেকে এক টাকাও বেশিতে আমি আলু বীজ বিক্রি করি না।
বর্তমান মৌসুমে বরগুনায় আলু বীজের কেমন সংকট রয়েছে জানতে চাইলে বরগুনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. আবু সৈয়দ মো. জোবায়দুল আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বরগুনা জেলায় ছয়টি উপজেলার মধ্যে পাথরঘাটায় আলুর চাষ বেশি হয়। পাথরঘাটায় সব থেকে বেশি বীজের চাহিদা রয়েছে। বরগুনায় বীজ সংকট এবং দাম বৃদ্ধি তেমন হয়নি। কিছু ব্যবসায়ী ও সিন্ডিকেট মূল্য বৃদ্ধির চেষ্টা করেছিল, তবে আমাদের স্থানীয় কৃষি দপ্তর ও স্থানীয় প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিয়েছে। আশা করি বরগুনা জেলায় যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তা অর্জন করা সম্ভব হবে।
কৃষকদের বীজ উৎপাদনে কোল্ডস্টোরেজের বিষয়ে তিনি বলেন, পাথরঘাটায় একটি কোল্ডস্টোরেজ থাকলেও তা শুরু থেকেই চালু করতে পারেনি। আমরা চাই একটি কোল্ডস্টোরেজ স্থাপন হোক, তাহলে এ অঞ্চলের কৃষকরা লাভবান হবেন। পাশাপাশি আলু বীজের আর কোনো সংকটও তৈরি হবে না।
বরগুনার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শফিউল আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, অতিরিক্ত মূল্যে আলু বীজ বিক্রি এবং কৃত্রিম সংকট বন্ধে উপজেলা নির্বাহী অফিসাররা ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছেন। আমাদের নির্দেশনা দেওয়া আছে। কৃষকরা যাতে ন্যায্যমূল্যে বীজ পায় সে লক্ষ্যে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা, বিএডিসি ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারের যৌথ উদ্যোগে ইতোমধ্যে কাজ শুরু হয়েছে। আশা করি কৃষকদের যে কোনো সমস্য থাকলে তা সমাধান হবে।
আরএআর