পরিযায়ী পাখিদের নির্ভয় বিচরণে মুখরিত তিস্তা
তিস্তা নদীর পাড়ে এখনো পুরোদমে হাড় কাঁপানো শীতের দাপট জেঁকে বসেনি। তবে এরই মধ্যে দুর্লভ পরিযায়ী পাখিদের আনাগোনায় তিস্তা যেন ফিরে পেয়েছে পাখিকেন্দ্রিক সৌন্দর্য। বালুময় তিস্তার চরগুলো পরিযায়ী পাখিতে মুখরিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নদীর পাড়ে বাড়ছে পাখিপ্রেমী দর্শনার্থীদের ভিড়।
নীলফামারীর ডালিয়া পয়েন্ট থেকে রংপুরের কাউনিয়া পর্যন্ত প্রায় ৬৫ কিলোমিটার তিস্তা নদী এবং নদীর চরে এখন বিচরণ করছে অগণিত পরিযায়ী পাখি। এর কোনোটা হাজার মাইল দূর থেকে এসে মোহনীয় করে তুলছে প্রকৃতি ও পরিবেশ। তিস্তা এখন পরিযায়ী পাখির নির্ভয় বিচরণ ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।
শীতের শুরুতেই নদীর পাড়ে পরিযায়ী পাখির দলবেঁধে ওড়াউড়ি, ছোটাছুটি আর ডুব সাঁতারের সুন্দর মুহূর্ত দেখে মুগ্ধ মাঝি, কৃষাণ-কৃষাণি ও স্থানীয়রা। ঝাঁকে ঝাঁকে পরিযায়ী পাখির উড়ন্ত দৃশ্য উপভোগ করতে পিছিয়ে নেই দর্শনার্থীসহ শৌখিন আলোকচিত্রীরাও।
জানা গেছে, প্রতি বছর ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পরিযায়ী পাখির কলতানে মুখর হয়ে ওঠে তিস্তা নদীর এপার-ওপার। এবারও পাখি আসছে। এবার বেশ কিছু নতুন পরিযায়ী পাখির দেখা পাওয়া গেছে। নদীর পরিবেশ-প্রকৃতি অনুকূলে থাকায় তিস্তাকে নিরাপদ আশ্রয়স্থল মনে করছে এ পাখিগুলো। নদীতে শামুক, জলজ পোকামাকড় তাদের খাদ্য। তিস্তায় এসব খাদ্য পাওয়া যায় বলে এখানে বিচরণ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে পাখিগুলো।
তিস্তাকে যেন পাখির নির্ভয় বিচরণ ক্ষেত্রে পরিণত করা যায় এজন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগের দায়িত্বশীলদের এগিয়ে আসা উচিত বলে মনে করছেন প্রকৃতিপ্রেমীরা। সুদূর সাইবেরিয়া, মধ্য এশিয়া, দক্ষিণ চীন, লাদাখ থেকে এসব পাখি আসছে। এর মধ্যে বিভিন্ন প্রজাতির দুর্লভ হাঁস, ছোট কান প্যাঁচা, লম্বা পা তিসাবাজ, জিরিয়া, টিটি, মনকান্ড, চখাচখিসহ ৫০ থেকে ৫৫ প্রজাতির পাখির দেখা মেলে তিস্তায়।
গেল কদিন ধরে তিস্তা নদীর পাড়ে ছবি ও পাখির খোঁজে দিনভর ঘুরেছেন শৌখিন আলোকচিত্রী কবি ও লেখক রানা মাসুদ এবং ফটোসাংবাদিক রণজিৎ দাস। তাদের সঙ্গে ছিলেন ব্যবসায়ী ও সমাজসংগঠক আলমগীর হোসেন, রংপুর চেম্বারের পরিচালক হাসান মাহবুব আখতার লোটনসহ কয়েকজন। ক্যামেরার লেন্সে বালুচর তিস্তার কোথাও পানি কোথাও আবার সবুজের হাতছানি, এমন দৃশ্যের সঙ্গে উঠে আসে তিস্তার কিছু পরিযায়ী পাখিদের আনাগোনাও। একেকটি ছবি যেন বলে দেয় পরিযায়ীরা তিস্তার পাড়ে আসছে দলবেঁধে ওড়াউড়ি ছোটাছুটি করতে।
আলোকচিত্রী রানা মাসুদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রতি বছরই দুর্লভ পাখি দেখতে এবং ছবি তুলতে তিস্তাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যাই। এবার তিস্তায় গত বছরের চেয়ে বেশি পাখির আগমন ঘটেছে বলে মনে হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, আগে ভোর হতেই পাখির কলকাকলিতে আমাদের ঘুম ভাঙত বলেই কবির কবিতায় পাখির কথা উঠে এসেছে। কিন্তু আমরা আমাদের নদী, প্রকৃতি ও পরিবেশ প্রতিনিয়ত ধ্বংস করছি। পাখির বাসযোগ্য স্থানগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে উড়ে আসা পরিযায়ী পাখিদের জন্য আমাদের নদীমাতৃক এ দেশের সৌন্দর্য যেমন মন কাড়ে, তেমনি কষ্টও লাগে যখন দেখি শিকারির হাতে বন্দী পাখি।
তিস্তায় বিভিন্ন সময়ে আসা এসব দুর্লভ পাখির ছবি তুলেছেন নদী গবেষক ও শৌখিন আলোকচিত্রী বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক ড. তুহিন ওয়াদুদ।
তিস্তায় দুর্লভ পাখির বিচরণ সম্পর্কে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রতি বছর ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিস্তায় কমবেশি পরিযায়ী পাখি আসে। প্রতি বছরের মতো এবারও আসছে। তবে এবার বেশ কিছু নতুন পরিযায়ী পাখির দেখা পাওয়া যাচ্ছে তিস্তায়। নদীর পরিবেশ-প্রকৃতি পাখিদের অনুকূলে থাকায় তিস্তাকে নিরাপদ আশ্রয়স্থল মনে করছে এ পাখিগুলো।
পেশাগত কাজে তিস্তাপাড়ের গংগাচড়ায় গিয়ে পাখির সঙ্গে ক্যামেরার মিতালী হয়েছে সাংবাদিক মাহফুজ আলম প্রিন্সের। তিনিও মনের আনন্দে পরিযায়ী পাখির বিচরণ ক্যামেরার ফ্রেমে বন্দী করেছেন। এই গণমাধ্যমকর্মী বলেন, শীত এলেই পাখিগুলো যে কোথা থেকে আসে জানি না। তবে শীতের চোট যত বাড়বে ততই পাখির আনাগোনা বাড়বে এই তিস্তায়। এত এত পাখির কলকাকলিতে মনটা ভালো হয়ে যায়। তখন পাখির মতো ওড়াউড়ি করে বেড়াতে মনটা ছটফট করে।
পাখিরা যেমন মেঘের কোলে হেলে দুলে উড়ে উড়ে বেড়ায়, তেমনি ছবির খোঁজে বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে বেড়ান ফটোসাংবাদিক রণজিৎ দাস। রংপুরের স্থানীয় একটি দৈনিক পত্রিকায় কর্মরত সিনিয়র এ ফটোসাংবাদিক ঢাকা পোস্টকে বলেন, অনেক বছর ধরেই তিস্তা নদীর তীরে পাখি আসে। এই নদীর সঙ্গে অতিথি পাখিদের হৃদয়ের সম্পর্ক অনেক গভীর। শীত এলেই পাখপাখালির মেলবন্ধনে তিস্তাপাড় মুখরিত হয়ে ওঠে। শুধু ছবি তোলার জন্য নয় কখনো কখনো মনের প্রশান্তির খোঁজে পাখির কলতান আর হইহুল্লোড় দেখতে নদীপাড়ে ছুটে আসি।
চর জেগে তিস্তার পেটে এখন তেমন পানি নেই। কোথাও হাঁটু পানি কোথাও বা কোমর পর্যন্ত। তবে বালুময় তিস্তার কোনো কোনো জায়গায় পাড়ভাঙা ক্ষতচিহ্ন যেমন অসহায়ত্ব জানান দিচ্ছে, তেমনি কোথাও কোথাও সামান্য পানিতে নৌকার মাঝি ছোটাছুটিও নজর কাড়ছে পাখিপ্রেমীদের। নৌকায় চড়ে স্থানীয় আব্দুর রহিম, নির্মল রায়, আরিফুল ইসলাম, আলমগীর হোসেনসহ কয়েকজন যুবক ঘুরে ঘুরে পাখির বিচরণ দেখে মুগ্ধ।
এ যুবকেরা বলেন, অসচেতনতার অভাবে সামান্য স্বার্থের কারণে বা শখের কারণে অনেকেই শীতের এ মৌসুমে পরিযায়ী পাখিদের শিকার করে থাকেন। এতে করে আমরাই আমাদের এই সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশকে ধ্বংস করছি। নদী ও প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষার জন্য পাখির বিচরণক্ষেত্র রক্ষা করতে হবে। আমাদের দেশ ক্রমেই অতিথি পাখির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। শুধু আইন দিয়েই পাখি শিকার বন্ধ করা যাবে না। সর্বস্তরের মানুষকে এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে।
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এমজেইউ