উঁচু পাহাড়ে কমলা চাষে সফল সুদত্ত চাকমা
তথ্যপ্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে অনেকেই স্বাবলম্বী হচ্ছেন। রাঙামাটির সুদত্ত চাকমাও এদের মধ্যে একজন। ইউটিউবে ভিডিও দেখে কমলা চাষ করে সফল হয়েছেন তিনি। উঁচু পাহাড়ে কমলা চাষে তার এই উদ্যোগ ইতোমধ্যেই সাড়া ফেলেছে পুরো জেলাজুড়ে। বাগান দেখতে প্রতিদিন দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসছে নানা শ্রেণি-পেশারর মানুষ।
রাঙামাটি পার্বত্য জেলার নানিয়ারচর উপজেলার ২নং নানিয়ারচর ইউনিয়নের তয় চাকমা দোসর পাড়া গ্রামের বাসিন্দা সুদত্ত চাকমা। বছর তিনেক আগে চার একর পাহাড়ি জমিতে কমলা চাষ শুরু করেন। কলম চারা এবং বীজের মাধ্যমে প্রায় আট শতাধিক গাছ দিয়ে আবাদ শুরু করেন। মাঝখানে পাহাড়ি ঢলের বন্যায় কিছুটা ক্ষতি সাধন হলেও গত বছর থেকে ফল দেয়া শুরু করে গাছগুলো। বাগানে এখন থোকায় থোকায় ঝুলছে সুস্বাদু কমলা। এই কমলা সুস্বাদু ও রসালো হওয়ায় এর বেশ চাহিদা রয়েছে জেলা এবং জেলার বাইরে। স্থানীয় বাজারগুলোতে প্রতিকেজি ৩০০ থেকে ৪০০ টাকায় বিক্রি হয় এই কমলা। এ ছাড়াও বাগান থেকে সরাসরি ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায়ও বিক্রির জন্য পাঠানো হয় এই কমলাগুলো।
বাগানে গিয়ে দেখা যায়, শীতের সকালের কুয়াশার আমেজ কেটে ধীরে ধীরে উত্তাপ ছড়াতে শুরু করেছে সূর্য। রাঙামাটি-খাগড়াছড়ি সড়কের পাশের একটি বাগানে ছোট চারার পরিচর্যা করছেন একজন। তার পেছনেই রয়েছে বিশাল কমলা বাগান। বাগানজুড়ে গাছগুলোতে থোকায় থোকায় ঝুলছে কমলা। বাগানের কর্মচারীরা গাছ থেকে ফল সংগ্রহ করে গাড়িতে তুলছেন বিক্রির উদ্দেশে পাঠানোর জন্য। বাগানের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে আশপাশের অনেক জায়গা থেকে বাগান দেখতে এসেছেন অনেক দর্শণার্থী। কথা হয় তাদেরই কয়েকজনের সঙ্গে।
নানিয়ারচর উপজেলার বাসিন্দা সুখিময় চাকমা বলেন, প্রত্যন্ত পাহাড়ি গ্রামে উঁচু পাহাড়ি পরিবেশে এমন সুন্দর কমলা বাগান হতে পারে তা চোখে না দেখলে বিশ্বাসই হতো না। সাধারণত পাহাড়ে আনারস, আদা এসবের চাষ বেশি হলেও এই কমলা চাষের ইতিহাস খুব বেশি দিনের না। এই বাগান দেখে অন্যান্যরাও উদ্বুদ্ধ হবে বলে আমার বিশ্বাস।
আরেক দর্শনার্থী শফিকুল ইসলাম বলেন, আগে অনেক ছোটখাটো বাগানে গিয়েছি। কিন্তু এই প্রথম এতবড় বাগানে আসলাম। বাগানটা দেখে সত্যিই মুগ্ধ হয়েছি। বাগানের ফল খুবই রসালো। আমিও এরকম একটি বাগান করতে আগ্রহী।
মহালছড়ি থেকে বাগান দেখতে আসা শেফালিকা চাকমা বলেন, আমি লোকমুখে শুনেছিলাম এইবার এই বাগানে খুব ভালো ফলন হয়েছে, তাই দেখতে এসেছি। ফলভর্তি বাগানটা দেখতে খুব সুন্দর লাগছে, আমি কিনেও নিয়ে গেলাম।
বাগান পরিচর্যাকারী মিত্র চাকমা বলেন, আমরা জুলাই মাস থেকে গাছগুলোর পরিচর্যা করছি। বর্তমানে বেশিরভাগ গাছেই ভালো ফলন হয়েছে। বিক্রি উপযোগী কমলাগুলো আমরা বিক্রির জন্য নিয়ে যাচ্ছি।
এ বিষয়ে বাগান মালিক সুদত্ত চাকমা বলেন, ইউটিউবে ভিডিও দেখে বাগান করার ব্যাপারে আমার আগ্রহ হয়। পরে চার একর জমিতে আমি প্রায় হাজার খানেক কলম চারা ও বীজের মাধ্যমে আবাদ শুরু করি। এখানে চায়না কমলা ও দার্জিলিং-১ এই দুই জাতের কমলা আছে। পাশাপাশি বারি-১ ও পাকিস্তানি ইয়োলো জাতের মাল্টাও রয়েছে। কৃষি বিভাগের সহায়তায় এবং আমাদের পরিচর্যার কারণে গত বছর থেকে গাছে ফল আসতে শুরু করে। এই বছর ফলনের পরিমাণ অনেক ভালো হয়েছে। আমি পুরো বাগান প্রায় ৪ লাখ টাকায় বিক্রি করেছি।
তিনি আরও বলেন, আমাদের মতো কৃষি উদ্যোক্তাদের যদি সরকারি প্রণোদনা ও ঋণ দেওয়া হয় তাহলে অনেকেই নতুন নতুন ফসল চাষে আগ্রহী হবে এবং উদ্যোক্তা হতে চাইবে।
এ নিয়ে নানিয়ারচর উপজেলা কৃষি অফিসের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মিনু বেগম বলেন, প্রথমে মালিক শখের বশে বাগানটি শুরু করেছিলেন। এরপর আমরা কৃষি বিভাগ থেকে নানা রকম পরামর্শ ও কারিগরি সহায়তা প্রদান শুরু করি যাতে তিনি বাগানটি বাণিজ্যিকভাবে করতে পারেন এবং স্বাবলম্বী হন। এই বছর বাগানে বাম্পার ফলন হয়েছে এবং তিনি আর্থিকভাবে বেশ লাভবান হয়েছেন। আমরা কৃষি বিভাগ সবসময় তার পাশে থাকবো। যাতে এই সফলতা দেখে অন্যান্যরাও কৃষি উদ্যোক্তা হতে চায়।
বাংলাদেশ অ্যাগ্রিকালচার ইন্ডাস্ট্রিজের অডিট অফিসার নজরুল ইসলাম বলেন, আমরা আগে আম, কাঁঠালসহ অন্যান্য ফল নিয়ে কাজ করেছি। এইবার প্রথম পাহাড়ি এলাকায় পরীক্ষামূলকভাবে কমলার ওপর আমাদের মেডিসিনগুলো প্রয়োগ করে অভাবনীয় সাফল্য পেয়েছি। আমরা আশা করছি আমাদের মেডিসিনগুলো ব্যবহার করে কৃষকরা ভালো ফল পাবেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর রাঙামাটি অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক তপন কুমার পাল বলেন, পার্বত্য অঞ্চলের জলবায়ু ও আবহাওয়া কমলা চাষের জন্য উপযোগী। একসময় সাজেকের কমলার খুব সুনাম ছিল। এখন নানিয়ারচর, বাঘাইছড়ি, বিলাইছড়িসহ বিভিন্ন উপজেলায় কৃষকরা কমলা চাষে আগ্রহী হচ্ছেন। কমলা চাষে পরিচর্যাটা বেশি প্রয়োজন হয়। তাই আমরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে কৃষকদের চারা সংগ্রহ থেকে শুরু করে ফল আসা পর্যন্ত কারিগরি সহায়তা ও পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি। আশা করছি ভবিষ্যতে পার্বত্য অঞ্চল কমলার জন্য বিখ্যাত হয়ে উঠবে।
মিশু মল্লিক/এএস/এএমকে