আ.লীগ নেতার মামলায় দুই বছর ধরে আটকে আছে সড়কের নির্মাণকাজ
কুষ্টিয়া সদরে আওয়ামী লীগ নেতার ‘দখলবাজির দৌরাত্ম্য’ ও মামলার কারণে প্রায় তিন বছর ধরে দুই লেন সড়কের নির্মাণকাজ বন্ধ রয়েছে। শতকোটি টাকার মেগা প্রকল্পের প্রায় এক কিলোমিটার সড়ক পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। এক পাশের রাস্তা দিয়েই যানবাহন ও পথচারীরা যাতায়াত করছেন। এতে স্বাভাবিক চলাচলে বাধাগ্রস্তসহ চরম ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে সড়কটি। প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা ও প্রতিদিনই ভোগান্তি পোহাচ্ছে লাখো মানুষ।
জানা গেছে, রাস্তার কাজ শুরুর পর কুষ্টিয়া সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রেজাউল হক জমির মালিকানা দাবি করেন এবং ২০২১ সালের ১২ মে ৯৯ শতক জমির ওপর দিয়ে রাস্তা নির্মাণ না করার জন্য সড়ক ও জনপথ বিভাগ কুষ্টিয়াকে চিঠি দেন। পরে ২০২২ সালে কুষ্টিয়া সদর সহকারী জজ আদালতে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে আবেদন করেন। কুষ্টিয়া আদালত নিষেধাজ্ঞা না দেওয়ায় একই বছরে তিনি হাইকোর্টে আবেদন করেন। ২০২২ সালে হাইকোর্ট তিন মাসের নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। এরপর দফায় দফায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেন হাইকোর্ট।
রেজাউল হকের দখলবাজির দৌরাত্ম্য ও মামলার কারণে ১৪১ কোটি টাকা ব্যয়ে চার লেন প্রকল্পের রাস্তার কাজ বন্ধ রয়েছে। একইসঙ্গে সংযুক্ত প্রকল্পের ড্রেনেজ ব্যবস্থা ও দৃষ্টিনন্দন ফুটপাতসহ সড়কের সৌন্দর্যবর্ধন কাজও বন্ধ রয়েছে। বারবার প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হলেও সমস্যা সমাধান ও প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করতে পারেনি সড়ক বিভাগ। এতে ক্ষোভ প্রকাশ করে দ্রুত এ সমস্যার সমাধানের দাবি জানিয়েছেন চলাচলকারী মানুষ, যানবাহন চালক ও স্থানীয় বাসিন্দারা।
সড়ক বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০২০ সালে কুষ্টিয়া পৌর এলাকার বটতৈল থেকে শহরের প্রাণকেন্দ্র মজমপুর গেট এবং মজমপুর গেট থেকে ত্রিমোহনী পর্যন্ত মোট ১০ কিলোমিটার দুই লেন সড়কটি চার লেনে উন্নীতকরণের কাজ শুরু হয়। এই কাজ দুই ভাগে ভাগ করা হয়। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান জহিরুল লিমিটেড বটতৈল থেকে মজমপুর গেট পর্যন্ত ৫ কিলোমিটারে ১৪১ কোটি টাকা ব্যয়ে এই কার্যাদেশ পায়।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান মেসার্স জহিরুল লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী জহিরুল ইসলামের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করলেও তিনি রিসিভ করেননি।
এ ছাড়া মজমপুর গেট থেকে ত্রিমোহনী পর্যন্ত ৫ কিলোমিটার দুই লেন সড়কটি চার লেনে উন্নীতকরণে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান স্পেক্ট্রা ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড ১৪৭ কোটি টাকা ব্যয়ে কার্যাদেশ পায়। তারা প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করেছেন।
সূত্রে আরও জানা যায়, সড়কের দুইপাশে দৃষ্টিনন্দন ফুটপাত নির্মাণ ও ডিভাইডারে গাছ লাগিয়ে সৌন্দর্যবর্ধনও এ প্রকল্পের (মেসার্স জহিরুল লিমিটেড) আওতাভুক্ত। ২০২২ সালের জুনে কাজটি শেষ হওয়ার কথা থাকলেও বেশ কয়েকবার সময় বাড়ানো হয়। এরপরেও কাজ শেষ হয়নি।
পথচারী, যানবাহন চালক ও স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, আওয়ামী লীগের নেতার মামলার কারণে মেগা প্রকল্প চার লেন প্রকল্পের রাস্তার কাজ বন্ধ হয়ে রয়েছে। প্রায় তিন বছর ধরে আমরা চরম ভোগান্তি পোহাচ্ছি। বটতৈল থেকে মজমপুরে যেতে বিআরবি ফ্যাক্টরির সামনে প্রায় এক কিলোমিটার রাস্তা পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। সেটি ব্যবহারের অনুপযোগী। পরিত্যক্ত রাস্তায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গাড়ি পার্কিং করে রাখা হয়। বাধ্য হয়ে রাস্তার একপাশ দিয়েই পথচারী ও যানবাহন চলাচল করতে হচ্ছে। এতে চরম দুর্ভোগ ও ভোগান্তি পোহাতে হয়। এ ছাড়া মাঝেমধ্যেই ঘটে দুর্ঘটনা। এখন পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনায় কয়েকজন নিহত হয়েছেন। আহত হন অনেকেই। দ্রুত এ সমস্যা সমাধানের দাবি জানিয়েছেন তারা।
এ বিষয়ে স্থানীয় জুয়েল রানা বলেন, প্রায় তিন বছর ধরে রাস্তাটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। একপাশের রাস্তা দিয়েই পথচারীরা ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করেন। এতে প্রায় প্রতিদিনই দুর্ঘটনা ঘটেছে, এ পর্যন্ত কয়েকজন মারাও গেছেন। আওয়ামী লীগের নেতার মামলা যেন মরণ ফাঁদ। তার একটি মামলার কারণে সড়কে ঝরছে মানুষের প্রাণ। আমাদের এই ভোগান্তি দেখার কেউ নেই। দ্রুত এই সমস্যা সমাধানের দাবি জানাচ্ছি।
স্থানীয় বাসিন্দা মকলেছুর রহমান বলেন, টাকা খাওয়ার জন্য আওয়ামী লীগের নেতা রেজাউল হক সরকারি রাস্তা নিজের দাবি করে মামলা করেছে। রাস্তাটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। তার মামলার কারণে প্রায় তিন বছর ধরে প্রতিদিনই এই রাস্তায় চলাচলকারী লাখ লাখ মানুষ ভোগান্তি পোহাচ্ছে। একপাশে চলাচলকারী রাস্তা দিয়েই যানবাহন ও পথচারীরা যাতায়াত করে। এতে প্রতিদিনই দুর্ঘটনা ঘটেছে। আমাদের এই দুঃখ-দুর্দশার সমাধান তো এই সরকার করতে পারে। সরকারের কাছে এই সমস্যার সমাধান চাই।
কুষ্টিয়া বিসিক শিল্পনগরীর সামনে প্রায় এক কিলোমিটার জমির মালিকানা দাবি করে সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রেজাউল হকের মামলার কারণে বটতৈল থেকে মজমপুর গেট পর্যন্ত ফোর লেন প্রকল্পের কাজ বন্ধ হয়ে রয়েছে। তবে জমিটি তার নয় বলে জানা গেছে। জমিটির মালিক জেলা পরিষদ। এ বিষয়ে কথা বলার জন্য রেজাউল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশত্যাগের পরই এলাকা ছেড়ে আত্মগোপনে রয়েছেন ওই নেতা। তিনি একাধিক মামলার আসামি। বর্তমানে তার সম্পর্কে কেউ কোনো তথ্য দিতে পারছেন না। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম, দুর্নীতি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ৫ আগস্টের পর তারা আত্মগোপনে চলে যান।
কুষ্টিয়া সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মুহাম্মদ মনজুরুল করিম বলেন, একটি মামলার কারণে চার লেন প্রকল্পের সড়কের কাজ বন্ধ রাখতে হয়েছে। আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিষয়গুলো সমাধানের জন্য কাজ চলছে। সমাধান হলে ওই রাস্তার কাজ দ্রুত শেষ করা হবে।
রাজু আহমেদ/এএমকে