কিশোর রাফিকে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ, পরে অস্ত্র দিয়ে মামলা
বাবাকে না পেয়ে কিশোর ছেলেকে অস্ত্র দিয়ে ফাঁসানোর অভিযোগ উঠেছে কক্সবাজারের টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) গিয়াস উদ্দিনের বিরুদ্ধে। ‘বাবাকে ক্রসফায়ার দেওয়া হবে’ এমন ভয় দেখিয়ে ওই কিশোরের কাছ থেকে মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়েছে বলেও অভিযোগ করেছে পরিবার।
ভুক্তভোগী কিশোরের নাম তাউসিফুল করিম রাফি (১৫)। সে স্থানীয় হ্নীলা উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র এবং টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়নের দরগাহ পাড়া গ্রামের রেজাউল করিমের ছেলে।
রাফির পরিবারের অভিযোগ, ভোররাতে ঘুমন্ত রাফিকে ঘর থেকে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। এরপর পরিবারের কাছে তিন লাখ টাকা ঘুষ চাওয়া হয়। তা দিতে অস্বীকার করায় রাফিকে অস্ত্র মামলায় ফাঁসানো হয়।
এ ঘটনায় টেকনাফে নানা আলোচনা-সমালোচনা চলছে। স্থানীয় লোকজন ও মানবাধিকার কর্মীদের অভিযোগ, টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) গিয়াস উদ্দিন এই থানায় তার পূর্বসূরি বিতর্কিত পুলিশ কর্মকর্তা প্রদীপ কুমার দাশের পথে হাঁটা শুরু করেছেন। তার বিরুদ্ধে এমন আরও অভিযোগ শোনা যাচ্ছে।
কিশোর রাফির ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত এবং ওসিসহ অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তাদের শাস্তি দাবি করেন তারা।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, পুলিশের এজাহার, সাক্ষীদের বক্তব্য এবং পরিবারের অভিযোগে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য রয়েছে।
জানা গেছে, গত ২৬ নভেম্বর ভোররাতে টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান রেজাউল করিমের বাড়িতে অভিযান চালায় টেকনাফ মডেল থানার ওসি গিয়াস উদ্দিনের নেতৃত্বে একটি দল।
পুলিশের দাবি- অভিযানের সময় রেজাউল করিম পালিয়ে যান। তখন তার সপ্তম শ্রেণি পড়ুয়া ছেলে রাফিকে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
কিন্তু রাফির মা নাছিমা আক্তার বলছেন ভিন্ন কথা। তিনি বলেন, ভোর ৪টার দিকে পুলিশের একটি দল দরজা ধাক্কাতে শুরু করে। দরজা খুলতেই তারা আমার স্বামীকে খুঁজতে থাকে। কিন্তু তিনি বাড়িতে ছিলেন না। পরে তারা ঘরের ভেতর ঢুকে ঘুমন্ত রাফিকে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে যায়। পাশের একটি বাড়িতে নিয়ে যায়, কিন্তু কোনো কারণ বলেনি। আমরা পরবর্তীতে রাফির সাথে কথা বলে জানতে পারি যে, আমার স্বামীকে ক্রসফায়ার দেওয়া হবে এমন ভয় দেখিয়ে রাফির মিথ্যা ভিডিও রেকর্ড করা হয়েছে।
নাছিমা অভিযোগ করে বলেন, আমার ছেলেকে থানায় নিয়ে যাওয়ার পর এক পুলিশ কর্মকর্তা তিন লাখ টাকা দাবি করেন। টাকা দিতে অস্বীকার করায় তাকে অস্ত্র মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার হুমকি দেন। পুলিশ আমাদের জানায়, তারা পাশের বাড়ি থেকে অস্ত্র উদ্ধার করেছে। অথচ পরে শুনি সেই অস্ত্র রাফির কাছে পাওয়া গেছে বলে দেখানো হয়েছে।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ২৬ নভেম্বর থানার এসআই (নিরস্ত্র) বদিউল আলম অবৈধ অস্ত্র রাখার অপরাধে তাউসিফুল করিম রাফির বিরুদ্ধে মামলা করেন। ওই মামলায় রাফিকে কক্সবাজারের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে আদালতে তোলা হয়। আদালতের বিচারক কামাল হোসেন সিকদার আসামিকে কক্সবাজার কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। রাফিকে বর্তমানে কক্সবাজার কারাগারের শিশু ও কিশোর ওয়ার্ড নতুন কুড়িতে রাখা হয়েছে। তাকে গাজীপুর শিশু নিরাময় কেন্দ্রে পাঠানোর প্রস্তুতিও চলছে।
জোরপূর্বক বানানো হয়েছে সাক্ষী
মামলার প্রধান সাক্ষী হ্নীলা এলাকার স্থানীয় মসজিদের খতিব ও ইমাম জামাল হোসেন। তিনি বলেন, ফজরের নামাজ পড়ানোর জন্য মসজিদে যাচ্ছিলাম। পথে আমাকে থামিয়ে ওসি গিয়াস উদ্দিন পরিচয় দিয়ে একটি বাড়িতে নিয়ে যান। সেখানে সিঁড়ির পাশে একটি কালো রঙের জিনিস দেখিয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, আমি কিছু দেখেছি কি না। কিন্তু আমি কিছুই দেখিনি।
জামাল হোসেন বলেন, পুলিশ আমাকে জোর করে একটি খালি কাগজে স্বাক্ষর দিতে বাধ্য করেছে। আমি কোনো অপরাধমূলক কিছু দেখিনি। অথচ আমাকে সাক্ষী বানানো হয়েছে।
মামলার দ্বিতীয় স্বাক্ষী প্রবাসী নুরুল আমিনের স্ত্রী সুমাইয়া আক্তার বলেন, ভোররাতে নারী পুলিশ সদস্যরা আমার ঘরে ঢুকে আলমারি তল্লাশি করে। পরে বলে, তারা অস্ত্র পেয়েছে। কিন্তু পরদিন শুনি, সেই অস্ত্র আমার ঘর থেকে নয়, রাফির কাছ থেকে উদ্ধার দেখানো হয়েছে।
লোক ভাড়া করে ওসির পক্ষে মানববন্ধন
এ ঘটনায় ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছে টেকনাফ মডেল থানা। বিষয়টি ধামাচাপা দিতে ওসি গিয়াস উদ্দিন মাদক মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া কয়েকজন ব্যক্তিকে দিয়ে রাফির পরিবারের বিরুদ্ধে মানববন্ধন করিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
মানববন্ধনে অংশ নেওয়া কয়েকজন ব্যক্তি এর আগে ইয়াবাসহ র্যাব ও পুলিশের হাতে আটক হয়েছিলেন। স্থানীয় বাসিন্দা আবদুল্লাহ বলেন, ওসি মাত্র দুই মাস হলো টেকনাফ থানায় দায়িত্ব নিয়েছেন। এত অল্প সময়ে তার এমন কোনো কৃতিত্ব নেই, যার জন্য সাধারণ মানুষ তার পক্ষে মানববন্ধন করবে। এটি পুরোপুরি সাজানো একটি নাটক।
মানবাধিকার কর্মীদের প্রতিক্রিয়া
জাতীয় শিশু-কিশোর সংগঠন খেলাঘর জেলা কমিটির সভাপতি সুবিমল পাল পান্না বলেন, একজন কিশোরকে এভাবে রাতের আঁধারে তুলে নিয়ে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো অত্যন্ত দুঃখজনক এবং নিন্দনীয়। এটি শিশু সুরক্ষা আইন লঙ্ঘনের বড় উদাহরণ। অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তাদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা উচিত।
তিনি আরও বলেন, টেকনাফে প্রদীপ কুমার দাশের কুখ্যাত কর্মকাণ্ডের যে ধারা ছিল, তা আবার ফিরে আসছে। এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত এবং জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া দরকার। না হলে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে।
পুলিশের বক্তব্য
অভিযোগের বিষয়ে টেকনাফ মডেল থানার ওসি গিয়াস উদ্দিন বলেন, রাফির বাবা রেজাউল করিম একজন চিহ্নিত সন্ত্রাসী এবং মাদক কারবারি। আমরা তার বাসায় অভিযান চালাই। অভিযানকালে রাফির কাছ থেকে একটি নীল রঙের ব্যাগে বিদেশি পিস্তল, ৬ রাউন্ড গুলি এবং ৪০ রাউন্ড কার্তুজ উদ্ধার করি। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে ব্যবহারের জন্য এই অস্ত্র মজুত রাখা হয়েছিল।
তবে পুলিশের বিবৃতি এবং এজাহারের মধ্যে অসঙ্গতি রয়েছে। এজাহারে বলা হয়েছে, রাফির ডান হাতে থাকা ব্যাগ থেকে অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। অথচ সাক্ষীরা বলছেন, সেই অস্ত্র পাশের বাড়ির আলমারি থেকে উদ্ধার দেখানো হয়েছে।
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার রহমত উল্লাহ বলেন, এ ঘটনায় ওসির বিরুদ্ধে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তদন্ত করছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে ওসির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
খোঁজ নিতে বলেছেন হাইকোর্ট
এদিকে বুধবার (৪ ডিসেম্বর) টেকনাফের কিশোর রাফিকে অস্ত্র মামলায় ফাঁসানোর অভিযোগ নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে আসা প্রতিবেদন হাইকোর্টের নজরে আনা হয়েছে। সকালে বিষয়টি নজরে আনার পর বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রাষ্ট্রপক্ষকে এ বিষয়ে খোঁজ নিতে বলেছেন।
আরএআর