দক্ষিণাঞ্চলে জলাতঙ্কের ভ্যাকসিন সংকট, বেশি দাম নিচ্ছে ফার্মেসি
বরগুনার আমতলী উপজেলা সদরের স্কুলছাত্রী সীমা ক্লাস শেষে বাসায় ফিরছিলেন। এ.কে স্কুলের মোড়ে কুকুরে কামড়ায় তাকে। তাকে উদ্ধার করে দ্রুত উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হলে সেখানে অ্যান্টি র্যাবিস ভ্যাকসিন (এআরভি) না থাকায় হাসপাতাল থেকে পটুয়াখালী অথবা বরগুনা জেলা সদর হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। ওই দিন আমতলী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কুকুরে কামড়ানো ২৭ রোগী আসেন।
তার একদিন পর উপজেলার বিভিন্ন স্থানে থেকে কুকুড়ে কামড়ানো ৫১ জন রোগী আসেন বলে জানান উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মেডিকেল অফিসার ডা. তানভীর শাহরিয়ার। তিনি বলেন, প্রায় প্রতিদিনই কুকুড়ে কামড়ানো অসংখ্য রোগী ভ্যাকসিনের জন্য আসছে। আমরা দিতে পারছি না। জলাতঙ্ক রোধে আমাদের স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কোনো ভ্যাকসিন না থাকায় আক্রান্তদের জেলা সদর হাসপাতালে পাঠাতে হয়।
শুধু আমতলীতেই নয় বিভাগের ৪২টি উপজেলার সবগুলো উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিত্র একই। এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, আক্রান্তদের মধ্যে ভ্যাকসিনের জন্য হাহাকার চলে। সরকারিভাবে না পেয়ে বাধ্য হয়ে দোকান থেকে চড়া দামে কিনে ব্যবহার করতে হচ্ছে। দ্রুতই এই সমস্যার সমাধান হওয়ার সম্ভাবনা নেই বলে জানিয়েছে বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের দপ্তর।
বরিশাল জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. মলয় কৃষ্ণ বড়াল জানান, কুকুর ও বিড়ালের কামড়ে গত বছর নভেম্বর-ডিসেম্বরে যে সংখ্যক রোগী আসতো এ বছর তার চেয়ে অনেক বেশি আসছে। গত ১৫ দিনে সদর হাসপাতালের বুথে আক্রান্ত হয়ে শুধু প্রথম ডোজের ভ্যাকসিন নিয়েছেন প্রায় এক হাজার জন। বছরের ব্যবধানে আক্রান্তের সংখ্যা কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়ায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে সেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। রোগীরা চাহিদা মতো ভ্যাকসিন না পেয়ে বাইরে থেকে বেশি দামে কিনতে বাধ্য হচ্ছেন।
বরিশালের হিজলা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ মাজেদুল হক কাওছার বলেন, এক সপ্তাহ আগে আমি হিজলা থেকে বদলি হয়ে এসেছি। আমি যখন কর্মস্থল ত্যাগ করি তখনো ভ্যাকসিনের কোনো সরবরাহ ছিল না।
এই চিকিৎসক বলেন, কয়েক মাস ধরেই আমরা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে ভ্যাকসিনের চাহিদা জানিয়ে আবেদন করেছিলাম। আমাদের জানানো হয়েছে দ্রুতই ভ্যাকসিন সরবারহ করা হবে। কিন্তু তা আর করা হয়নি।
বরিশালের সিভিল সার্জন ডা. মারিয়া হাসান জানান, চাহিদা অনুযায়ী ভ্যাকসিন কখনোই সরবরাহ হয় না। অধিদপ্তরে যা চাহিদা পাঠানো হয় তার অর্ধেকেরও কম পাচ্ছি। ভ্যাকসিন আনতে হয় বরিশাল থেকে ঢাকা গিয়ে। যে কারণে বাড়তে থাকা আক্রান্তের চাপ সামলানো আরও কঠিন হয়ে পড়ছে দিন দিন।
একই তথ্য জানান ১০০ শয্যাবিশিষ্ট বরগুনা জেলা সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. এ. কে. এম. নাজমুল আহসান। তিনি বলেন, আমাদের হাসপাতালে জলাতঙ্ক রোগের ভ্যাকসিন আছে। তবে প্রতিদিন যে সংখ্যক রোগী আসছেন তা সামলাতে হিমশিম খেতে হয়।
ভ্যাকসিনের বাজারে সিন্ডিকেট
ভোলা, পিরোজপুর, ঝালকাঠি ও পটুয়াখালী হাসপাতালগুলোতে খোঁজ নিয়ে ভ্যাকসিন সংকটের একই তথ্য পাওয়া গেছে। সরকারিভাবে সরবরাহে অপ্রতুলতা থাকায় বাজারে গড়ে উঠেছে সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেটের কবলে প্রতিদিনই প্রতারিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। তেমনই একজন বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার রঙ্গশ্রী ইউনিয়নের শহিদুল ইসলাম।
তিনি বলেন, অক্টোবরের শেষ দিকে আমাকে কুকুরে কামড় দেয়। উপজেলার হাসপাতালে গেলে এক ঘণ্টা বসিয়ে রেখে জানায় তাদের কাছে ভ্যাকসিন নেই। বাইরের একটি দোকানের নাম বলে দিয়ে জানায় সেখান থেকে কিনে আনতে। সেই দোকানে কিনতে গেলে আমার কাছে প্রথম ডোজের দাম ১৫০০ টাকা রেখেছে। পাশে দেখলাম আরেক জনের কাছ থেকে ১৬০০ টাকা রাখছে।
শহিদুল বলেন, সরকার ভ্যাকসিন সরবরাহ করতে না পারলে অন্তত বাজারটি নিয়ন্ত্রণে রাখুক। সরকার দিতে পারবে না আবার ক্রেতা যে কিনবে তারও ব্যবস্থা করবে না, তাহলে চলবে কেমনে?
কথা হয় বরিশাল নগরীর ভাটিখানা এলাকার বাসিন্দা শুভজিতের সঙ্গে। তিনি বলেন, সাধারণত এক ডোজ ভ্যাকসিনের দাম দেড় হাজার টাকা। তবে আরও কমেও কিনে আনা সম্ভব। আমি গত বছর এমন একটি সিন্ডিকেটে পড়েছিলাম। প্রথম ডোজ দেড় হাজার টাকায় কিনে দিয়েছি। এরপর যত ডোজ বাড়লো ততই দাম বাড়ায় ফার্মেসি মালিকরা। বিভিন্ন অজুহাতে তারা দাম বাড়ায়। ফার্মেসিওয়ালারা জানে ভ্যাকসিন ডোজ কমপ্লিট করতে হবে রোগীকে। এই সুযোগে তারা যে দামে চাইবে সেটাই রাখবে।
কুকুরে কামড়ানো ভ্যাকসিনের দাম জানতে কয়েকটি ফার্মেসির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা ভিন্ন ভিন্ন দাম জানান। ব্যবসায়ীরা জানান, কুকুর, বিড়াল, ইঁদুর দ্বারা আক্রান্ত রোগীকে ভ্যাকসিন দিতে হয়। এক ডোজ ভ্যাকসিন ৫০০-৫৫০ টাকায় বিক্রি হয়। কুকুরের কামড়ে গভীর ক্ষত করলে র্যাবিস ভ্যাকসিনের পাশাপাশি র্যাবিস ইমোনোগ্লোবিন (র্যাবিস আইজি) দিতে হয়। আইজি ভ্যাকসিনের দাম ৮০০ থেকে ১২০০ টাকা। দুটো মিলিয়ে দেড় থেকে দুই হাজার বিক্রি হতো। এ বছর ভ্যাকসিনের সংকট আরও বেড়ে যাওয়ায় দাম কিছুটা বাড়তি।
দুজন ব্যবসায়ী বলেন, আমাদের করার কিছু নেই। বেশি দামে কিনে বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।
যা বলছে কর্তৃপক্ষ
ভ্যাকসিনের সংকটের কথা স্বীকার করে বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. শ্যামল কৃষ্ণ বড়াল বলেন, ব্যয়বহুল এই ভ্যাকসিন বাইরে থেকে কিনে দিতে সাধারণ মানুষের কষ্ট হয়, এটা বুঝি। কিন্তু ভ্যাকসিনের সরবারহ কম থাকায় আমাদের করার কিছুই নেই। আগে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সরবারহ থাকলেও আপতত নেই। এখন আমরা জেলা সদরের হাসপাতাল ও সিটি করপোরেশন থেকে দিচ্ছি। ভ্যাকসিনের সংকট থাকায় চাইলেও সব স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্র থেকে দেওয়া যাচ্ছে না। কবে নাগাদ এই সংকট কাটবে সেটিও বলা যাচ্ছে না। ভ্যাকসিন ব্যয়বহুল হওয়ায় অনিশ্চয়তা রয়েছে।
আরএআর