ব্যতিক্রমী পাঠদানে বদলে গেছে প্রাথমিক বিদ্যালয়
একটি বিদ্যালয়কে ঘিরে বদলে গেছে প্রত্যন্ত গ্রাম। শিশুবান্ধব, প্রাকৃতিক ও স্বপ্নিল পরিবেশে গড়ে ওঠা বিদ্যালয়টি শিক্ষা বিস্তারে অবদান রাখছে। ২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে বিদ্যালয়টি রংপুর বিভাগের মধ্যে শ্রেষ্ঠ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের স্বীকৃতি পেয়েছে। এর আগে ২০২৩ সালে বিদ্যালয়টি জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ প্রাথমিক বিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃতি পায়। স্কুলের প্রধান শিক্ষক, শিক্ষা কর্মকর্তা ও স্থানীয়রা প্রত্যাশা করেন দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলার প্রত্যন্ত তেঁতুলিয়া গ্রামের সুব্রত খাজাঞ্চী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি দেশের শ্রেষ্ঠ প্রাথমিক বিদ্যালয় হবে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, চিরিরবন্দর উপজেলার তেঁতুলিয়া গ্রামের সুব্রত খাজাঞ্চী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রবেশপথের দুই পাশে ফুলের গাছ, আঙিনায় নানা ধরনের খেলার সরঞ্জাম, মাঠে বিদ্যালয়ের ভবনের ছাদে বিভিন্ন ফুল-ফলের গাছ। সরকারি সহায়তার পাশাপাশি স্থানীয়দের সহযোগিতায় বদলে ফেলা হয়েছে শিক্ষার পরিবেশ। সিসিটিভি ক্যামেরায় নিয়ন্ত্রিত এ বিদ্যালয়ে শিশুদের আকর্ষণের জন্য রয়েছে দোলনা, সরাৎ, ঢেঁকিকল, ফুলের বাগান, সবজি বাগান শিশুদের আকর্ষণের জন্য রয়েছে হরেক রকম বিনোদনের উপকরণ। বিভিন্ন খেলার সামগ্রী। রয়েছে শহীদ মিনার, বিভিন্ন মানচিত্র, সততা স্টোর, সুসজ্জিত শ্রেণিকক্ষ, মনোরম এমন পরিবেশে পড়াশোনা ও খেলাধুলার সুযোগ পেয়ে বিদ্যালয়মুখী শিক্ষার্থীরা।
এতে নৈতিকতা, পড়াশোনা, শিক্ষাদান ও উপস্থিতিসহ বিভিন্ন দিক দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে সুব্রত খাজাঞ্চী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি। জাতীয় সংগীত ও শপথ বাক্য পাঠের পর কেউ অনুপস্থিত থাকলে শিক্ষকের ফোন তাৎক্ষণিক চলে যায় অভিভাবকের কাছে। সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন প্রধান শিক্ষক জগদীশ চন্দ্র রায়।
স্থানীয়রা বলছেন, চিরিরবন্দর উপজেলাকে বলা হয় শিক্ষানগরী। এখানে শতাধিক নামকরা প্রাইভেট কিন্ডার গার্টেন স্কুল আছে। সেখানে এখন সরকারি প্রাইমারি স্কুলগুলোতে ছাত্র-ছাত্রী কোনোটাতে আছে, আবার কোনোটাতে একবারে নাই বললেই চলে। সেখানে ব্যতিক্রম সুব্রত খাজাঞ্ছী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। প্রাইভেট স্কুলের মতো এখানকার প্রধান শিক্ষক সব সময় স্কুলে থাকেন। তার সঙ্গে যারা সহকারী শিক্ষক আছেন তারাও স্কুল ফাঁকি দেন না। স্কুলের শিক্ষকরা পাঠদান করেন খেলার ছলে, গানের সঙ্গে। এ গ্রামে আগে কোনো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল না। এই বিদ্যালয়টি বিভাগের সেরা। শুধু তেঁতুলিয়া গ্রামের না অন্য গ্রামের শিক্ষার্থীরাও এ বিদ্যালয়ে এসে লেখাপড়া করে। বিদ্যালয়টি তেঁতুলিয়া গ্রামের মুখ উজ্জ্বল করেছে।
শিক্ষার্থী খাদিজা আক্তার বলে, বিদ্যালয়ে পড়ালেখার পাশাপাশি অনেক খালার সামগ্রী আছে। শিক্ষকরা আদর করে ডেকে লেখাপড়া করান। তাই প্রতিদিন স্কুলে আসি।
শিক্ষার্থী মিরাজ হোসেন বলে, এই স্কুলে অনেক ভালো লেখাপড়া হয়। স্কুলের মাঠে একটা বাগান আছে। সেই বাগানের জায়গায় এখন বিভিন্ন ধরনের খেলনাসামগ্রী বসানো হয়েছে। একদম পার্কের মতো।
প্রথম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক কল্পনা রায় বলেন, আমার মেয়ে এখানে ক্লাস ওয়ানে পড়ে। আমাদের বাড়ির কাছে একটা সরকারি স্কুল আছে। কিন্তু ছাত্র-ছাত্রী একদম কম। লেখাপড়া ঠিকমতো হয় না। তাই একটু দূরে হলেও এই স্কুলে ভর্তি করিয়েছি। এখানে ভালো লেখাপড়া হয়।
আরেক শিক্ষার্থীর অভিভাবক নুর ইসলাম বলেন, আমার মেয়ে এই স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে পড়ে। এ স্কুলে পড়ালেখা ভালো হয়। স্কুলের পরিবেশ সুন্দর হওয়ায় আমার মেয়েকে স্কুলে আসার কথা বলতে হয় না। কারণ এখানকার শিক্ষকরা বাচ্চাদের আদর যত্ন ভালোবাসা দিয়ে পাঠদান করান। এ স্কুলে অনেক দূর থেকে বাচ্চারা লেখাপড়া করতে আসে। এ স্কুলটা রংপুর বিভাগের মধ্যে প্রথম হয়েছে এ জন্য।
বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক শাহিনা আক্তার বলেন , আমাদের স্কুলটি বিভাগের সেরা হওয়ার পেছনে আমাদের যেমন অবদান তেমন আছে, এখানকার শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদেরও অবদান রয়েছে। আমাদের স্কুলে শিক্ষার্থীদের শতভাগ উপস্থিতি। কোনো কারণে বাচ্চা অসুস্থ বা আত্মীয়র বাসায় গেলেও স্কুলে এসে বলে যান অভিভাবকরা। কোনো কারণে কোনো শিক্ষার্থী ক্লাসে না এলে আমরা হোম ভিজিট করে তাদের বিষয়ে জানতে পারি। স্কুলের বাহ্যিক পরিবেশ, শিক্ষা উপকরণ, প্রধান শিক্ষকের স্কুল পরিচালনার কৌশল সম্পূর্ণ ভিন্ন। এজন্য শিক্ষর্থীরা স্কুল আসতে নিজেরাই আগ্রহী।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জগদীশ চন্দ্র রায় বলেন, সুব্রত খাজাঞ্চী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি ২০১৩ সালে স্থাপিত। ২০১৪ সালে ৩৩ জন শিক্ষার্থী নিয়ে শুরু হয় পাঠদান। এখন বিদ্যালটিতে তিন শতাধিকের বেশি ছাত্র-ছাত্রী রয়েছে। প্রথম যে ৩৩ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছিল তারা উপবৃত্তি না পাওয়ায় যে স্কুলে উপবৃত্তি দেয় সেই স্কুলে গিয়ে ভর্তি হয়। তখন আমি চেষ্টা করি কীভাবে ছাত্র-ছাত্রী ও অভিভাবকদের এ স্কুলের প্রতি আকর্ষণ করা যায়। কারণ এখান বেসরকারি কিন্ডার গার্ডেন স্কুলে শিক্ষার্থী ও অভিভাকদরে আগ্রহ বেশি। তাই লেখাপড়ার দিকে মনোযোগ বাড়াতে হবে। প্রাইভেট স্কুলে যা আছে সরকারি স্কুলে তার থেকে বেশি থাকবে। এজন্য স্থানীয়দের সঙ্গে আলোচনা করে তাদরে সহযোগিতা নিয়ে কাজ শুরু করি। স্কুলটি এখন জেলা উপজেলা শেষে বিভাগের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বিদ্যালয়। আশা করছি দেশসেরা হবে বিদ্যালয়টি।
চিরিরবন্দর সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা সাজ্জাদ হোসেন বলেন, জাতীয় শিক্ষা পদক প্রতিযোগিতায় বিভাগীয় পর্যায়ে সুব্রত খাজাঞ্চী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রথম হয়েছে। এ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের যে কর্মপরিকল্পনা, তার যে কর্মদক্ষতা, বিদ্যালয়ের প্রত্যেকটি কর্মক্ষেত্রে তার ছোঁয়া রয়েছে। স্কুলের প্রত্যেকটি শ্রেণিতে প্রধান শিক্ষকের ক্লাস রয়েছে। শিক্ষার্থীদের শতাভাগ অংশগ্রহণে স্কুলের সকল শিক্ষক-শিক্ষিকা দায়িত্ব পালন করেন। বিদ্যালয়টিতে ক্লাসরুম থেকে শুরু করে বিদ্যালয়ের মাঠে খেলার সামগ্রী, বিভিন্ন ফুল ও ফলের গাছের সমাহার। বিদ্যালয়ের ভবনের ছাদে বাগান। এখানে শিক্ষার্থীদের শেখার যে কলাকৌশল তা যে কাউকে মুগ্ধ করবে। বিদ্যালয়টি জাতীয় পর্যাবয়ে প্রথম হওয়ার দাবি রাখে।
সোহাগ/আরএআর