৩২ বছরেও ঐতিহ্য ধরে রেখেছে সাধুর দোকানের জিলাপি
পিরোজপুর শহরের বাজার রোডের একটি জিলাপির দোকানে কোনো সাজসজ্জা নেই, নেই কোনো সাইনবোর্ড কিংবা নামফলকও। খুব ছোট্ট এই দোকানটি সবার কাছে পরিচিত সাধুর দোকান নামে। তাই এ দোকানের জিলাপির নাম হয়ে গেছে সাধুর দোকানের জিলাপি। স্বাদে-গুণে অসাধারণ ও রসে ভরা মুচমুচে এই জিলাপি সুদীর্ঘ ৩২ বছর ধরে তার ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। ফলে নামহীন এই দোকানে সারা বছরই ভিড় লেগে থাকে। গরম গরম জিলাপি তোলার সঙ্গে সঙ্গেই খেতে বসে মানুষ। কড়াই থেকে জিলাপি তোলার ফুরসতটুকুও পাননা কারিগররা। সবার সামনেই ডুবোতেলে ভেজে চিনির সিরায় ডুবিয়ে কাগজের ঠোঙায় কারিগররা পরিবেশন করেন গরমগরম জিলাপি। অনেক সময় ক্রেতা সামলাতেও হিমশিম খেতে হয় তাদের।
জানা যায়, ১৯৯২ সালে পিরোজপুর শহরের বাজার রোড এলাকায় এ জিলাপির দোকানের যাত্রা শুরু হয়। জিলাপির ব্যবসা শুরু করেন অমূল্য কৃষ্ণ দে (৭২) নামের এক মিষ্টির কারিগর। ৫২ বছর ধরে তিনি এ জিলাপি তৈরির কাজ করে আসছেন। মূলত প্রথমে জিলাপির পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি দিয়ে দোকান শুরু করলেও ধীরে ধীরে প্রচলিত হতে থাকে এ দোকানের জিলাপি। তখন দোকানটির নাম ছিল পদ্মা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। তবে ধীরে ধীরে দোকানের নামফলকটি নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর আর তার দরকার পড়েনি। সাধুর দোকানের জিলাপি নামেই পরিচিতি পায় দোকানটি। তবে এখনো জিলাপি, মিষ্টি দেওয়ার প্যাকেটটির গায়ে লেখা আছে পদ্মা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার নাম। শুরু থেকে এই দোকানের প্রধান কারিগর ছিলেন দোকানের মালিক অমূল্য কৃষ্ণ দে নিজেই। তার সহযোগী হিসেবে অনেক কারিগর এ দোকানে কাজ করেছেন। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পিরোজপুর শহরের অনেক কিছুরই পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু শহরের পুরোনো সেই জিলাপির ঐতিহ্য আছে আগের মতোই। সাধুর দোকানের জিলাপির কদর এখন শুধু দেশে নয় এর কদর পৌঁছেছে দেশের বাইরেও। সম্প্রতি এক ক্রেতা এই জিলাপি কিনে নিয়ে গেছেন আমেরিকাতে। ভারতের কলকাতায়ও আছে এই জিলাপির অনেক ক্রেতা।
সরেজমিনে দেখা যায়, দোকানের সামনে বড় একটি কড়াইয়ে তেল ভর্তি করে সেখানে জিলাপি ভাজছেন কারিগর অমূল্য কৃষ্ণ দে। অন্য একটি কড়াইয়ে এই ভাজা জিলাপি চিনির সিরায় ডোবাচ্ছেন আরেক কারিগর অসিম কুমার ঘরামি। কিছুক্ষণ চিনির সিরায় ডুবিয়ে তারপর তুলে রাখছেন আর একটি পাত্রে। আর ক্রেতারা অপেক্ষা করছেন সদ্য বানানো জিলাপি খাওয়ার জন্য। বিকেলে মানুষের নাস্তার অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে সাধুর দোকানের জিলাপি। সম্পূর্ণ কেমিক্যালমুক্ত ও কোনো প্রকার রং ছাড়াই আড়াই প্যাঁচের জিলাপি তৈরি হয় বলে ক্রেতাদের মন টানে। ফলে ছোট্ট দোকানটিতে সবসময়ই ক্রেতাদের উপচে পড়া ভিড় লক্ষ করা যায়।
কথা হয় পিরোজপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত জারিকারক মো. সোহরাব হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমার প্রথম জীবন থেকেই এই সাধুর দোকানের জিলাপি খাই। এই দোকানের জিলাপির খুব চাহিদা। শুক্রবারে জিলাপি চাহিদা অনুযায়ী ভাজতেও পারেন না। এ জিলাপিতে কোনো প্রকার ভেজাল দেওয়া হয় না।
জিলাপি কিনতে এসেই খেতে বসে যান এক ক্রেতা। তিনি বলেন, বিষয়টি হলো বিভিন্ন জায়গায় জিলাপি ভাজে। যত কম ভাজে জিলাপির ওজন তত বেশি থাকে। কিন্তু এখানে ওরকম চিন্তা করে না এখানে একটু ভালো করে ভাজে। রংটাও একটু বাদামি বর্ণের হয়ে যায়। খেতে খুব তরতাজা, মচমচে ও মিষ্টি লাগে। যে জন্য আমি মাঝেমধ্যে এখানে জিলাপি খেতে আসি, অন্য কোথাও খাই না। এখানে আমার আস্থা আছে যে ভালো জিলাপি এখানে পাওয়া যায়।
সিমা রানী নামে এক ক্রেতা বলেন, এখানে এলে অনেক ভালো মানের আমিত্তি, জিলাপি ও মিষ্টি পাই। বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও এখান থেকে মিষ্টি-জিলাপি নিই। এই দোকানের কোনো নাম নাই, কিন্তু খুব জনপ্রিয়তা আছে দোকানটির।
জিলাপি খেতে আসা মো. নাইম উদ্দিন নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, শহরের চুড়িপট্টি এলাকার ঐতিহ্যবাহী একটি দোকান এটি। এ দোকানে ৩০ থেকে ৩৫ বছর ধরে মিষ্টি, জিলাপি তৈরি করে আসছে। প্রতিদিন এক থেকে দুই মন জিলাপি তৈরি হয় এখানে। শুক্রবারে আরও বেশি হয়। আমরা আমাদের বাপ-দাদার কাছ থেকে এই দোকানের সুনাম শুনে আসছি। আমাদের প্রজন্মও এখান থেকে জিলাপি, মিষ্টি খাই। এমন দোকান পিরোজপুর শহরে আর একটিও পাওয়া দুষ্কর।
বাগেরহাট জেলার মোড়লগঞ্জ উপজেলা জিলবুনিয়া এলাকার বাসিন্দা ইলিয়াস হোসেন মল্লিক বলেন, আমাদের ঈদ, বিবাহসহ যেকোনো অনুষ্ঠানে এখান থেকে কেনাকাটা করি। অন্যান্য দোকানের তুলনায় এখানের দোকনদার ভালো। তা ছাড়া এখানকার মিষ্টি, জিলাপিও অনেক সুস্বাদু।
দোকানটির কারিগর অসিম কুমার ঘরামি বলেন, এখানে সাত থেকে আট বছর ধরে কাজ করছি। শুরু থেকে দেখছি এই জিলাপির খুব নাম। এখানের জিলাপি ভারত, আমেরিকাসহ বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছে।
দোকানের মালিক ও প্রধান কারিগর অমূল্য কৃষ্ণ দে বলেন, আমি ৫২ বছর ধরে মিষ্টি, জিলাপি তৈরি করে আসছি। মানুষের দোকানে ২০ বছর কাজ করেছি। এরপর এখানে নিজে দোকান দিয়েছি। এখানে ৩২ বছর দোকানদারি করি। আমার দোকানের জিলাপি এবং আমিত্তি খুব পরিচিত। সবার রুচি অনুযায়ী আমি এই জিনিস তৈরি করি। আমার দোকানের মিষ্টিতে আমি খারাপ কোনো কিছু দিই না। আমি মনে করি এ কারণেই আমার এত জনপ্রিয়তা হয়েছে। সবাই সাধুর দোকানের জিলাপি নামে চেনে। বাংলাদেশের বাইরে বিভিন্ন দেশে আমার এ জিলাপি যায়।
তিনি আরও বলেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে দাম কিছুটা বেশি তবে মান ধরে রাখা হয়েছে। ১৮০ টাকা কেজি দরে জিলাপি বিক্রি করা হয়। জিলাপি তৈরির সব উপাদানের দামই বেড়ে গেছে। তবে মান ধরে রেখে বছরের পর বছর জিলাপি তৈরি করে আসছি। স্বাদেও কোনো হেরফের নেই। তাই সাধারণ সময়ে দোকানটিতে দিনে এক থেকে দুই মন জিলাপি বিক্রি হয়। শুক্রবারে আরও বেশি করতে হয়। রোজার মাসে তো ২০০ কেজির ওপরে ছাড়িয়ে যায়।
জিলাপি তৈরির উপাদান সম্পর্কে তিনি বলেন, জিলাপি তৈরির জন্য চালের গুঁড়ো ও ময়দা ব্যবহার করা হয়। এ উপাদানগুলো পানিতে বিভিন্ন পরিমাণে মিশিয়ে রাখা হয় ছয়-আট ঘণ্টা। এর পরই তৈরি করা হয় ঐতিহ্যবাহী সাধুর দোকানের জিলাপি। তবে ভোজ্যতেল হিসেবে ব্যবহার করা হয় পামঅয়েল, কেননা সয়াবিন তেল দিলে একটা গন্ধ আসে। কয়েক ধরনের ময়দা আর ভালো তেল দিয়ে জিলাপি ভাজি। বছরের পর বছর একই কৌশল, একই স্বাদ।
উল্লেখ্য, ছোটবেলা থেকেই জিলাপির দোকানদার অমূল্য কৃষ্ণ দের পোশাকে ছিল ভিন্নতা। ছোট থেকেই তিতি সাদা রঙের লুঙ্গি আর সাদা ফতুয়া কিংবা গেঞ্জি পরে থাকতেন তিনি। তার এই সাদা পোশাকের কারণেই জিলাপি খেতে আসা মানুষেরা তাকে সাধু বলে ডাকা শুরু করে। এভাবেই তার নাম হয়ে যায় সাধু আর দোকানের নাম হয় সাধুর দোকান।
শাফিউল মিল্লাত/এএমকে