অর্থ ও জনবল সংকটে বরিশাল সিটি কর্পোরেশন, ব্যাহত নাগরিক সেবা
ছেলেকে নতুন স্কুলে ভর্তি করানোর প্রয়োজনীয়তায় নগরভবনে দুই সপ্তাহ ধরে জন্ম নিবন্ধন সনদ পেতে চেষ্টা করছেন বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের ২৩নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা মহসিন মিয়া। নানা জটিলতায় সনদটি পেতে দেরি হচ্ছে। নির্ধারিত সময়ে সনদ না পেলে ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করাতে পারবেন না। দুশ্চিন্তায় রাতের ঘুম হারাম তার। নগরভবনের গেটে দাঁড়িয়ে আক্ষেপ নিয়ে বলছিলেন, ‘প্রথমবার কইলো টিকা কার্ড লাগবে। জন্মের পর যে টিকা কার্ড ছিল তা হারিয়ে ফেলেছি। ছেলের বয়স ৭ বছর। এখন তো সেই কার্ড থাকার কথা না। হাম-রুবেলার কার্ড নিয়ে গেলে কর্পোরেশন থেকে জানালো, যে হাসপাতালে ছেলে হয়েছে তার রেজিস্ট্রারের ফটোকপি লাগবে। এটা কি পাওয়া সম্ভব? এখন কী করবো বুঝতেছি না।’
তিনি আরও বলেন, কাউন্সিলর এলাকার মানুষ। তিনি ওয়ার্ডবাসীকে চিনতেন। তারা দায়িত্বে না থাকায় কর্পোরেশনের যে কর্মকর্তারা ওয়ার্ডের দায়িত্বে তারা তো সকলকে চেনেন না। ফলে মারাত্মক ভোগান্তিতে আছি আমরা।
শুধু মহসিন মিয়া নন, বরিশাল সিটি কর্পোরেশনে প্রতিদিন এমন অসংখ্য মানুষ আসেন যারা সমস্যায় ভুগছেন কিন্তু সমাধানের পথ পাচ্ছেন না।
১১নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা রেবেকা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমগো শহরে বেমালা (ভয়ংকর) রকমের মশার উৎপাত বাড়ছে। সাদেক মেয়া যহন আছিল তহন, হের চাচায় (আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ) যহন আছিল তহনও মেশিন দিয়া ধোয়া (মশা নিধন ওষুধ) দিতো। এহন মেয়র-কাউন্সিলর নাই, আমগো দেহার কেউ নাই।’
২৫নং ওয়ার্ডে অর্ধেক খনন অবস্থায় পড়ে আছে ড্রেন। এতে করে চলাচল করতে পারছেন না ওই এলাকার মানুষ। রুহুল আমিন নামে এক বাসিন্দা বলেন, সরকার পতনের আগে ফকির বাড়ি এলাকায় কাজ শুরু হয়েছিল। প্রেক্ষাপট বদলে যাওয়ায় কাজ বন্ধ হয়ে আছে। আমরা চলাচলও করতে পারি না।
এমন অসংখ্য সমস্যা নিয়ে বরিশাল সিটি কর্পোরেশন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অর্থ বরাদ্দের অভাব, জনবল সংকটে ভুগছে প্রতিষ্ঠানটি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা সারাক্ষণ অসহ্য স্নায়ু চাপে থাকছি। সময়মতো দপ্তর সামলানো, কাজ শেষ করা এবং বিভিন্ন পরিচয়ের ব্যক্তিবর্গের অনর্থক চাপ প্রয়োগ আমাদের বিব্রত ও স্বাভাবিক কাজে বিঘ্ন ঘটায়।
আরেক কর্মকর্তা বলেন, একটু সমস্যা হলেই পার্টির লোক আসেন, ঠিকাদার আসেন, ছাত্র-জনতার পরিচয় দিয়ে আন্দোলন নিয়ে আসেন। তারা বিভিন্ন অনৈতিক সুবিধা পেতে এসব করছেন। কিন্তু আমরার কিছুই করতে পারি না। অব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে গেলেও অসম্ভব চাপের মধ্যে প্রতিদিন অফিস করি।
তিনি আরও বলেন, নগর ভবনের যে পদগুলো খালি তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই জনবল নিয়োগ হলে সিটি কর্পোরেশনের কার্যক্রমে আরও গতি ফিরতো।
সংশ্লিষ্ট শাখা বলছে, কর্পোরেশনের মোট ৮৭২ পদের বিপরীতে ৮২৩ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে শূন্য থাকা গুরুত্বপূর্ণ ৪৯টি পদের মধ্যে রয়েছে আঞ্চলিক নির্বাহীর তিনটি পদ, মেয়র/প্রশাসকের একান্ত সচিব, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, প্রধান প্রকৌশলী, প্রধান স্বাস্থ্য প্রকৌশলী, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী, স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, চিফ প্লানিং অফিসার, মেডিকেল অফিসার, সহকারী প্রকৌশলী সিভিল, সহকারী প্রকৌশলী বিদ্যুৎ, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, চিফ অ্যাসেসর, সহকারী অ্যাসেসর, অ্যাস্টিমেটর তিনটি পদ, সেবিকা, মেয়র/প্রশাসকের ব্যক্তিগত সহকারী কাম সাঁটলিপিকার, প্রশাসনিক শাখার কম্পিউটার অপারেটর, প্রধান রাজস্ব শাখার কম্পিউটার অপারেটর, স্ট্রিট লাইট ইন্সপেক্টর, উপ-কর কর্মকর্তা দুটি পদ, প্রশাসন শাখার উচ্চমান সহকারী ৫টি পদ, সচিবের দপ্তরের লাইব্রেরি সহকারী, সম্পত্তি শাখার সার্ভেয়ার দুটি পদে, স্যানেটারি ইন্সপেক্টর, লাইসেন্স ইন্সপেক্টর, সহকারী হিসাব রক্ষক, ফার্মাসিস্ট তিনটি পদে, পেশ ইমাম, নিরাপত্তা পরিদর্শক, ট্রাক টার্মিনাল কেয়ার টেকার, টেলিফোন অপারেটর, স্বাস্থ্য সহকারী দুটি পদ ও গাড়িচালক পদটি শূন্য রয়েছে। এছাড়া পাঁচ শতাধিক শ্রমিক দৈনিক মজুরির চুক্তিতে কাজ করছেন।
অর্থ বরাদ্দ না থাকায় স্তিমিত কার্যক্রম
২০১৮ সালে মেয়র হিসেবে সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ দায়িত্ব গ্রহণ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত নগর উন্নয়নে কোনো বরাদ্দ আনতে পারেনি। ওই বছরের ৯ নভেম্বর দায়িত্ব ছাড়ার পর তার চাচা আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ মেয়র হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর বরিশাল নগরীর প্রকল্প প্রস্তাবনার অনুকূলে ৭৯৭ কোটি টাকা একনেকে পাস করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর বেশ কয়েকটি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে হাত দেন সাবেক মেয়র। কিন্তু ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর পালিয়ে যান বরিশাল সিটির মেয়র আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ। ওইদিন বিক্ষুব্ধরা সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন স্থাপনায় ভাঙচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ করে প্রায় ১৯ কোটি টাকার ক্ষতি করে। ক্ষতিগ্রস্ত স্থাপনা মেরামতে যে পরিমাণ অর্থ দরকার তা কর্পোরেশনের ফান্ডে নেই। এমনকি সরকারি অর্থ বরাদ্দ না থাকায় কবে নাগাদ সংস্কার সম্ভব তাও বলতে পারেছেন না কর্মকর্তারা। এদিকে নগরীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সড়ক, ড্রেন সংস্কারের অনেকগুলো কাজ পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। শুধু নগরভবন কেন্দ্রিক সেবা, পরিচ্ছন্নতা আর মশক নিধনে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে এই মুহূর্তে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী আবুল বাশার ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ বিষয়ে তথ্য থাকলেও জানাতে পারবো না, দুঃখিত। সম্প্রতি গণমাধ্যমে তথ্য প্রদান সংরক্ষিত করতে আমাদের একটি অফিস আদেশে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হুমায়ূন কবির বলেন, কীসের বরাদ্দের বিষয়ে বলছেন? কবে বরাদ্দ এসেছে সিটি কর্পোরেশনে? একনেকে অনুমোদন আর বরাদ্দ এক কথা না। প্রকল্প সময় যতদিন থাকবে ততদিন কার্যক্রম চলবে।
অন্য তিনটি দপ্তরের শীর্ষ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সিটি কর্পোরেশনে দীর্ঘদিন ধরেই কোনো বরাদ্দ না আসায় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। নগরবাসীর কাছ থেকে আদায় হওয়া ট্যাক্স, পানির বিল দিয়েই স্তিমিত গতিতে নগর ব্যবস্থাপনা করা হচ্ছে।
পরিচ্ছন্নতা ও মশক নিধন
সিটি কর্পোরেশন এলাকার বিভিন্ন ওয়ার্ডের বাসিন্দারা পরিচ্ছন্নতা ও মশক নিধনের বিষয়ে অভিযোগ করলেও নগরভবনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা দাবি করেছেন স্বাভাবিক গতিতেই কার্যক্রম চালিয়ে নিচ্ছেন।
পরিচ্ছন্নতা শাখার প্রধান ইউসুফ আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, সবগুলো ওয়ার্ডে রাতে বড় ট্রাক দিয়ে ময়লা সংগ্রহ করে পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। মজুরি ভিত্তিক শ্রমিক দিয়ে এই কাজ ভালোভাবেই চলছে। আমরা চাচ্ছি যদি কোনো সংকট থাকেও তাতে যেন নগরবাসীর দুর্ভোগে পড়তে না হয়। আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি নগর পরিচ্ছন্নতায়।
মশক নিধন শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত স্বপন কুমার দাস বলেন, ৫২ জন শ্রমিক প্রতিদিন বিভিন্ন ওয়ার্ডে মশক নিধনে কাজ করে যাচ্ছেন। সাধারণত ফগার মেশিন ও স্প্রে দিয়ে কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। এখন আমাদের কাছে পর্যাপ্ত পরিমাণের মশা নিধনের ওষুধ আছে। সিটি কর্পোরেশনের চেষ্টায় বরিশালে ডেঙ্গু সংক্রমণ বাড়তে পারেনি। এখন পর্যন্ত মাত্র একজন ষাটোর্ধ্ব রোগী মারা গেছেন যার বাসা সিটি কর্পোরেশন এলাকায়। এ ছাড়া এই এলাকার এত রোগীও নেই।
এসব বিষয়ে সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রেজাউল বারী ঢাকা পোস্টকে বলেন, বেশ কয়েকটি পদে জনবল সংকট রয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি যথাযথ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে দ্রুত সময়ে শূন্য পদগুলো পূরণ করতে। শূন্য পদগুলো পূরণ হলে নগরভবনে কাজের গতি আরও ফিরবে। এ ছাড়া অন্যান্য যেসব সমস্যা রয়েছে সেগুলো লাঘবেও আমরা আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছি।
উল্লেখ্য, অন্তর্বর্তী সরকারের অধ্যাদেশে মেয়র ও কাউন্সিলর পদচ্যুত হলে বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক পদে বিভাগীয় কমিশনার দায়িত্বে রয়েছেন। আর বিভিন্ন কর্মকর্তাদের ওয়ার্ডের দায়িত্বে দেওয়া হয়েছে।
এমজেইউ