শুধু সীমানা প্রাচীর নির্মাণেই সীমাবদ্ধ রংপুর রেলস্টেশনের উন্নয়ন
প্রতিষ্ঠার প্রায় দেড়শ বছরেও বি-গ্রেডের হিসেবে চলছে রংপুর রেলওয়ে স্টেশনের কার্যক্রম। এর মধ্যে চলে গেছে ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমল। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পেরিয়েছে। জেলা থেকে রংপুর বিভাগ হয়েছে। পৌরসভা বিলুপ্ত হয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে সিটি কর্পোরেশন। প্রতিষ্ঠা হয়েছে রংপুর মহানগর পুলিশ। বেড়েছে নগর ও জেলার জনসংখ্যাও।
এত কিছুর পরও কিন্তু কাঙ্ক্ষিত প্রত্যাশানুযায়ী রংপুর রেলস্টেশনের তেমন কোনো উন্নয়ন হয়নি। উত্তরের বিভাগীয় নগরী রংপুরের রেলওয়ে স্টেশনটি জরাজীর্ণ ছাড়াও রয়েছে নিরাপত্তা ঝুঁকিতে। এ কারণে ক্ষোভ বেড়েছে মানুষের মনে।
অভিযোগ উঠেছে, ১৪৬ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত স্টেশনটিতে গত ৮০ বছরে তেমন কোনো উন্নয়ন হয়নি। রেলওয়ে স্টেশন রি-মডেলিং প্রকল্পের আওতায় দেশের অন্যান্য বিভাগীয় পর্যায়ের স্টেশন বদলে গেলেও প্ল্যাটফর্ম উঁচু করা আর বাউন্ডারি ওয়াল তৈরিতে সীমাবদ্ধ এর উন্নয়ন। এখন অবিলম্বে রংপুর থেকে ঢাকাগামী রেলের সংখ্যা বৃদ্ধি করাসহ রেলওয়ে স্টেশনের আধুনিকায়নের দাবি রংপুরবাসীর।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রংপুর রেলওয়ে স্টেশন ১৮৭৮ সালের ২ জুলাই প্রতিষ্ঠা করা হয়। বুড়িমারী-লালমনিরহাট-পাবর্তীপুর লাইনের পার্বতীপুর-কাউনিয়া অংশে রংপুর রেলওয়ে স্টেশন অবস্থিত। প্রতিষ্ঠার পর ১৯৪৪ সালে রংপুর স্টেশনের বড় ধরনের সংস্কার হয়। এরপর এ স্টেশনে বড় কোনো উন্নয়ন কার্যক্রম হয়নি। ইতোমধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সরকার দেশ শাসন করেছে। কিন্তু রংপুর রেলওয়ে স্টেশনকে এ-গ্রেডে উন্নীত করার কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। জন্ম থেকে এ স্টেশনটি বি-গ্রেডেরই রয়ে গেছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, রেলস্টেশনের যাত্রীদের ট্রেন থেকে পড়ে যাওয়ার দৃশ্য। অনেকেই এখন এটা মেনে নিয়ে নিয়মিত যাতায়াত করছেন। এ স্টেশনে ৩টি প্ল্যাটফর্ম থাকলেও একটি থেকে অন্যটিতে যেতে নেই কোনো উড়াল সেতু। ফলে খোলা রেললাইনের ওপর দিয়ে প্রতিনিয়ত ঝুঁকি নিয়েই ট্রেনে ওঠানামা করতে হয় যাত্রীদের। একটিমাত্র প্ল্যাটফর্মে গাদাগাদি করে অপেক্ষা করতে হয় নারী-পুরুষ নির্বিশেষে। দিন দিন যাত্রী সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ঝুঁকির আশঙ্কাও বেশি। স্টেশনের চারদিক এখনও খোলা। পুরো অরক্ষিত স্টেশনে রাত হলে মাদকসেবী ও অপরাধীদের আড্ডা বসে। সঙ্গে আছে ভাসমান মানুষের অবাধ বিচরণ।
বিভাগীয় শহরের এ স্টেশনে যাত্রীদের বিশ্রামাগার ও শৌচাগারের অবস্থাও শোচনীয়। একটি মাত্র টয়লেটের সামনে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয় সব শ্রেণির যাত্রীদের। রাতের নিরাপত্তা আর পরিবেশ নিয়েও আছে আনেক অভিযোগ। একটি মাত্র শৌচাগারে নারী-পুরুষকে অনেক হয়রানি হতে হয়। এমনকি টাকার বিনিময়ে এ জরুরি কাজ সারতে হচ্ছে। যাত্রীদের প্রত্যাশা, উন্নয়ন বৈষম্যের শিকার এ স্টেশনের আধুনিকায়নসহ সমস্যাগুলোর সমাধানে কাজ করবে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এ স্টেশনের দৃশ্যমান উন্নয়ন বাস্তবায়নের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা। গত ৬ অক্টোবর বুড়িমারী থেকে ছেড়ে পার্বতীপুরগামী লোকাল এলআর ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দিয়ে বিক্ষোভ মিছিল, সমাবেশ করেছেন।
আন্দোলনকারীদের অভিযোগ, প্রায় দেড়শ বছরের পুরাতন এ স্টেশনটিতে পদে পদে যাত্রীদের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। এ স্টেশনটিতে নেই পৃথক যাত্রী ছাউনি, পারাপারে ফুটওভার ব্রিজ, দ্বিতীয় প্ল্যাটফর্মে যাতায়াতের ব্যবস্থাসহ সীমানা প্রাচীর। বার বার রেলওয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ আশ্বাস দিলেও অজানা কারণে উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত রয়েছে। উত্তরের কোটি মানুষের ট্রেন যোগাযোগের গুরুত্বপূর্ণ স্টেশন রংপুর। অন্য লাইনে ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন স্থাপন হলেও রংপুর সেই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। আমরা এ বৈষম্যের অবসান ঘটাতে রংপুর রেলওয়ে স্টেশনের সংস্কার করে আধুনিকায়ন করাসহ নূন্যতম আরও দুটি আন্তঃনগর ট্রেন বরাদ্দের দাবি তাদের।
একই অভিযোগ যাত্রীদের। তারাও বলছেন, সুস্থ ও স্বাভাবিক যাত্রীদেরই ট্রেনে ওঠানামায় প্রচুর বেগ পেতে হয়। সেখানে অসুস্থ, বৃদ্ধ, অন্তঃসত্ত্বা ও শিশুদের ঝুঁকি আরও কয়েকগুণ বেশি। এ সমস্যা থেকে পরিত্রাণ চান তারা।
আরও পড়ুন
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন রংপুরের সমন্বয়ক মুহম্মদ রাজিমুজ্জামান হৃদয় বলেন, বিভাগীয় নগরী রংপুরে বর্তমানে ১০ লাখের বেশি মানুষের বসবাস। প্রতিদিন রংপুর থেকে বিপুলসংখ্যক মানুষ ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যাতায়াত করে থাকে। রেলভ্রমণ তুলনামূলক নিরাপদ হলেও রংপুরের মতো জেলায় রেলওয়ে স্টেশনসহ রেলপথে যোগাযোগ ব্যবস্থার তেমন কোনো উন্নয়ন হয়নি।
ট্রেনে করে প্রায়ই ঢাকায় যান ব্যবসায়ী জহুরুল হক। রংপুর নগরীর জুম্মাপাড়া এলাকার এ বাসিন্দা বলেন, রংপুর থেকে মাত্র দুটি রংপুর এক্সপ্রেস ও কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস ঢাকায় যায়। টিকিট পাওয়া মুশকিল ব্যাপার। যদি টিকিট মেলে তো ট্রেনের শিডিউল ঠিক থাকে না। প্রায়ই শিডিউল বিপর্যয় হয়ে থাকে । ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। এতে করে আমাদের কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। এছাড়া এ স্টেশনের পরিবেশ খুব একটা যাত্রী উপযোগী না। এখানে যেন সমস্যার শেষ নেই। বিভাগীয় শহর হিসাবে এ স্টেশনটি একেবারেই অবহেলিত ও বেমানান।
নগরীর স্টেশন এলাকার আফজাল হোসেন বলেন, স্টেশনের পাশে আমার বাসা। এখানে মাত্র একটি প্ল্যাটফর্ম। রাতের বেলায় নানা ধরনের মানুষ অহেতুক ঘোরাফেরা করে। প্ল্যাটফর্মের বিপরীত দিকে রাতে মাদকসেবীর আড্ডা হয়। অনেক সময় ছিনতাইয়ের ঘটনাও ঘটে। নির্দিষ্ট সীমানা প্রাচীর না থাকায় এখানে সবসময় বহিরাগতদের আনাগোনা থাকে। রাত হলে সেটা অনেক বেশি পরিমাণে হয়। একারণে রাতের যাত্রীরা অনেকটা নিরাপত্তাহীনতায় থাকে।
রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে এ স্টেশন দিয়ে কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস, রংপুর এক্সপ্রেস, দোলনচাঁপা এক্সপ্রেস, উত্তরবঙ্গ মেইল, দিনাজপুর কমিউটারসহ ৭ জোড়া ট্রেন আসা-যাওয়া করে। প্রতিদিন এ স্টেশন দিয়ে প্রায় সাত হাজার যাত্রী দেশের বিভিন্ন স্থানে চলাচল করছে। রংপুর রেলস্টেশনের পশ্চিমে বন্দর শ্যামপুর এবং পূর্ব দিকে মীরবাগ বাজার স্টেশনটি বি-গ্রেডের। কাগজেকলমে এ দুই রেলস্টেশনের সঙ্গে রংপুর স্টেশনের কোনো পার্থক্য নেই। কাউনিয়া রেলস্টেশন এ গ্রেডের হলেও জেলার মূল স্টেশনটি বি-গ্রেডের হওয়ায় ক্ষোভ বেড়েছে নগরবাসীর মনে।
এদিকে ২০২১ সাল রংপুর রেলওয়ে স্টেশনের উন্নয়নমূলক কাজের উদ্বোধন করা হয়। এ উন্নয়ন প্রকল্পে ছিল রংপুর রেলওয়ে স্টেশনে ৬ তলাবিশিষ্ট ভবন নির্মাণ, রেলের সমান প্ল্যাটফর্ম, প্ল্যাটফর্ম উঁচুকরণ, বর্তমান প্ল্যাটফর্মের বিপরীত দিকে আরেকটি প্ল্যাটফর্ম করা, অবৈধ অনুপ্রবেশ ঠেকাতে চারদিকে নিরাপত্তা বেষ্টনী নির্মাণসহ নানামুখী কাজ। শুধু প্ল্যাটফর্ম উঁচুকরণ দৃশ্যমান হওয়া ছাড়া কোনো কাজের অগ্রগতি হয়নি। এ নিয়ে যাত্রী এবং স্থানীয়দের মাঝে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।
উত্তরাঞ্চলে রেল যোগাযোগ সুবিধা বাড়াতে মিটার গেজের পাশাপাশি ব্রডগেজ লাইন নির্মাণ করে একসঙ্গে দুটি ট্রেনের চলাচল নিশ্চিত করা এবং উত্তরে রেল যোগাযোগ বৃদ্ধিতে যমুনা বহুমুখী সেতুর পাশে নির্মাণাধীন রেলওয়ে সেতুর কাজ সম্পন্ন না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করছেন রংপুরের সমাজকর্মী ও সংগঠক তানবীর হোসেন আশরাফি। তিনি রংপুর স্টেশনটির গ্রেড উন্নয়ন ও ট্রেনের সংখ্যা বৃদ্ধিসহ আধুনিকায়নের জোর দাবি জানিয়েছেন।
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন রংপুর মহানগর সভাপতি খন্দকার ফখরুল আনাম বেঞ্জু বলেন, যেখানে কাউনিয়া উপজেলার স্টেশনটি এ গ্রেডের, সেখানে রংপুর জেলা স্টেশনটি বি-গ্রেডের এটি মেনে নেওয়া কষ্টকর। বিভাগীয় নগরী হিসেবে দেড়শ বছর পুরোনো রেলস্টেশনে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, রংপুর হবে এক নম্বর জেলা। আমরা রেলও এক নম্বরে থাকতে চাই। সরকারপ্রধান এ ক্ষেত্রে দৃষ্টি দেবেন বলে আশা করছি।
স্টেশনের সুপারিনটেনডেন্ট শংকর গাঙ্গুলী বলেন, রংপুর বিভাগীয় শহর হলেও এ রেলস্টেশনটি ‘বি’ গ্রেডের। কিছু দিন আগে ছাত্ররা স্টেশনে এসে বিভিন্ন দাবি জানিয়েছে। রংপুর স্টেশনের যাবতীয় উন্নয়নের কাজের বরাদ্দ পাস হয়েছে কয়েক মাস আগে। কিন্তু হঠাৎ সরকার পরিবর্তনের পর এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কাজগুলো থমকে আছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ছাত্র-জনতার দাবির বিষয়গুলো নিয় কথা হয়েছে। আশা করছি খুব শিগগিরই রংপুরকে একটি আধুনিক মডেল স্টেশনে রূপ দেওয়ার কাজ শুরু হবে।
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/আরকে