‘এক লাখ মুক্তিযোদ্ধা হয়ে গেল তিন লাখ, এমন অন্যায় আর হবে না’
অন্তর্বর্তী সরকারের সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ বলেছেন, ২০২৪ এ এসে আমরা আমাদের প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধা ছেলেমেয়েদের চিহ্নিত করব। এখানে ভুল হবে না। ওই এক লাখ মুক্তিযোদ্ধা হয়ে যায় তিন লাখ, সেই অন্যায় আর হবে না। প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধাকে আমরা চিহ্নিত করব, প্রতিটি আহত-নিহতকে আমরা চিহ্নিত করব। যেই কষ্ট আমরা ৫৩ বছর ধরে বহন করেছি এবং মুক্তিযুদ্ধের নামে বার বার যে ভুল করেছি, সেটার অবসান ঘটলো। সেটা আমরা আর দ্বিতীয়বার করতে দেব না।
শনিবার (১৬ নভেম্বর) দুপুরে রংপুর শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে নিহত রংপুর বিভাগের শহীদ পরিবারের সদস্যদের মাঝে অনুদানের চেক বিতরণ অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন।
সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা বলেন, আমরা যুগে যুগে সমাজ ও রাজনীতি জীবনে যা অর্জন করেছি, তা ছাত্র-জনতার সংগ্রাম ও প্রতিবাদের ফল। ৫২ সাল, ৬৯, ৭০, ৭১ সাল এবং তারপর পদ্মা দিয়ে অনেক পানি বয়ে গেছে। অবশেষে ২০২৪ এসেছে। একাত্তরের যুদ্ধ দেখেছি, তারপর ২০২৪ দেখেছি। আমরা যে স্বপ্নটা দেখেছিলাম সাম্য, গণতন্ত্র, ন্যায্যতার মাধ্যমে একটা সুন্দর সমাজ গড়ে তুলব এবং ন্যায্যতার অধিকারেই আমাদের যুদ্ধ হয়েছিল। স্বাধীনতা পেয়েছি, মাটি পেয়েছি, পতাকা পেয়েছি কিন্তু আমাদের সেই স্বপ্নটা স্বপ্নই থেকে গেছে। একাত্তরে স্বাধীনতার পরে আমরা গণতন্ত্র পাইনি। সাম্য ও ন্যায্যের জায়গায় আমরা দাঁড়াতে পারিনি। এক লাখ মুক্তিযোদ্ধার পুনর্বাসন হয়নি। তাদের ভেতরে ৯০ শতাংশ ছিলেন গ্রামের ছেলে-মেয়েরা। তাদের খালি হাতে, খালি পায়ে গ্রামে ফিরে যেতে হয়েছিল। সেদিন আমরা দেশ গঠনের কাজে তাদের কাজে লাগাতে পারিনি।
তিনি আরও বলেন, এটা ছিল অন্যায়। আজকে ২০২৪ এর যে মুক্তিযোদ্ধারা আছেন তারা মুক্তিযুদ্ধের ধারা ও মূল্যবোধের বাহক। বিস্ময়করের সাথে দেখতে পাই ২০২৪ এর পুনর্জন্ম নিলো আরেকটি প্রজন্ম, যারা সেই আদর্শে যুদ্ধে নামলো। তাদের পুনর্বাসন, দেশ গড়া ও কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে দ্বিতীয়বার আমরা বিফল হবো না।
আরও পড়ুন
গণঅভ্যুত্থানে নিহত ও আহত পরিবারের সবাইকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করার অভিব্যক্তি প্রকাশ করে উপদেষ্টা বলেন, একাত্তরে আমরা যেটা করতে পারিনি, আজকে আমরা সেটা করে দেওয়া সম্ভব। কারণ এটাই এখন একমাত্র পথ। যারা ভাবছেন আমরা আবু সাঈদের গল্প বলছি বলে অন্যদের ভুলে যাচ্ছি, এটা ভুল ভাবছেন। আমরা তা করছি না। আবু সাঈদ একটা সিম্বল হতে পারে। কিন্তু সে সবাইকে প্রতিনিধিত্ব করেছে। আমরা আপনাদের সবার কাছে পৌঁছতে চাই। এই কাজটা সহজ না। তবে আমাদের আন্দোলনকারী ছেলেরা জুলাইয়ের বিপ্লবীরা আমাদের পাশে আছে।
তিনি বলেন, আমাদের কথা ও কাজের মধ্যে কিছু ভুল ত্রুটি হবে। আমাদের ওপর রাগ করবেন, সমালোচনা করবেন। এমনকি আমাদের তিরস্কারও করবেন। কিন্তু কেউ মুখ ফিরিয়ে নেবেন না। কারণ আমরা আমাদের অন্তর থেকে আপনাদের পাশে আছি। ভুল হবেই, ভুল শুধরে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। যারা এই গণঅভ্যুত্থানে আহত ও নিহত হয়েছেন, তারা আমাদের সত্যিই কাছে পাবেন।
একই অনুষ্ঠানে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা মিজ্ ফরিদা আখতার বলেন, একাত্তর সালে অনেক রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে যে এখন আমাদের ২০২৪ সালে এসে বলতে হচ্ছে দ্বিতীয় স্বাধীনতায় আমরা আরেকবার স্বাধীন। এই স্বাধীনতা তো আর বন্ধ করা যাবে না। এই স্বাধীনতা আমাদের টিকিয়ে রাখতে হবে। শহীদ পরিবারের কষ্ট আমরা কাউকে বলে বোঝাতে পারব না। বাবার কাঁধে সন্তানের লাশ, ভাইয়ের কাঁধে ভাইয়ের লাশ। কিন্তু মায়ের কান্না লাশ বহন করে না মায়ের বুকের ভিতরে বহন করে। আমরা শহীদ ও আহত পরিবারের পাশে থাকবো। যদি আমাদের কোনো গাফলতি হয় তাহলে আপনারা আমাদের প্রশ্ন করবেন। এটা আপনাদের অধিকার।
অনুষ্ঠানে অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন- পুলিশের রংপুর রেঞ্জ ডিআইজি আমিনুল ইসলাম, জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রবিউল ফয়সাল, জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ শরীফ উদ্দিন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ও জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ, শহীদ সাংবাদিক তাহির জামান প্রিয়’র মা সামসিয়ারা জামান কলি প্রমুখ।
আরও পড়ুন
অনুষ্ঠানের শুরুতে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের পর শহীদদের স্মরণে এক মিনিটের নিরবতা পালন করা হয়। পরে আলোচনা পর্ব শেষে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে জুলাই-আগস্টে রংপুর বিভাগের সব শহীদ ৬৬ পরিবারের মধ্যে ৪৪ জনকে আর্থিক সহযোগিতার চেক হস্তান্তর করা হয়। বাকিদের পর্যায়ক্রমে দেওয়া হবে।
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এফআরএস