হিংস্রতা ভুলে বাড়ির হাঁস-মুরগি পাহারা দেয় বাজপাখি
বাহাদুর নাম ধরে ডাক দিলেই কাছে এসে বসে বনের হিংস্র প্রাণী বাজপাখি। খাবার খেয়ে আবার চলে যায় বড় গাছের মগডালে। হিংস্র পশুপাখি থেকে বাড়ির হাঁস-মুরগির ছোটছানাকেও রক্ষা করে সে। ভালোবেসে বনের শিকারি হিংস্র পাখিকেও যে বসে আনা যায় তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ রোমান আর বাহাদুরের বন্ধুত্ব। মানুষ ও বন্য বাজপাখির এমন বন্ধুত্ব দেখা গেছে শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার বড় মূলনা গ্রামে।
প্রাণীপ্রেমী রোমান ছৈয়াল উপজেলার বড় মূলনা গ্রামের মজিবুর ছৈয়ালের ছেলে। তিনি ঠিকাদারের কাজ করেন।
স্থানীয় লোকজন ও রোমানের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কিশোর বয়স থেকেই পশুপাখি ভীষণ পছন্দ করতেন রোমান ছৈয়াল। দুই বছর আগে বাড়ির পাশের ফসলি জমি থেকে অসুস্থ অবস্থায় একটি বাজপাখি উদ্ধার করেন তিনি। পাখিটিকে সুস্থ্য করার জন্য জাজিরা উপজেলা ভেটেরিনারি হাসপাতালে নিয়ে যান রোমান। প্রায় দুই সপ্তাহের চিকিৎসা ও রোমানের সেবায় পাখিটি সুস্থ হয়ে ওঠে। সুস্থ্য হওয়ার পর পাখিটিকে বনে ছেড়ে দেন রোমান। কিন্তু অসুস্থ বাজপাখিটি অনুভব করতে পারে যে রোমানের ভালোবাসা ও সেবায় সুস্থ হয়েছে সে। তাই রোমানকে ছেড়ে যায়নি সে। পাখিটিকে বারবার বনে ছেড়ে দেওয়া হলেও সে রোমানের প্রতি ভালোবাসা দেখিয়ে আবার ফিরে এসেছে। এরপর থেকে রোমানের পরিবারের একজন সদস্য হিসেবে বাহাদুর নাম নিয়ে পরম যত্ন আর ভালোবাসায় বেড়ে উঠেছে বাজপাখিটি। পাখিটির খাবারের জন্য প্রতিদিন কিনে রাখা হয় নানা রকম মাছ।
প্রথম দিকে পরিবারের সদস্যরা বিরক্তি প্রকাশ করলেও এখন বাহাদুর বাড়ির ছোট বাচ্চার মতো সবার আদরের হয়ে উঠেছে। রোমানের পাশাপাশি তারাও পরম মমতায় সেবাযত্ন করেন বাহাদুরকে। বাহাদুরের কেউ যেন ক্ষতি করতে না পারে, সেদিকেও নজর রাখে রোমানের পরিবার। মানুষের ভালোবাসা পেয়ে বনের হিংস্রতা ভুলেছে বাহাদুরও। শিকারি পশুপাখি থেকে বাড়ির হাঁস-মুরগির ছোটছানাকে নিত্য রক্ষা করাই এখন বাহাদুরের প্রধান কাজ। রোমানের অনুপস্থিতিতে বাহাদুরের দেখাশোনা করেন রোমানের মা হোসনে আরা বেগম ও ছোট ভাই সাইম ছৈয়াল। দিনের বেলা বাড়ির চারপাশের বিভিন্ন বড় গাছ ও রাতে রোমানের ঘরের পাশের কোনো গাছে থাকে বাহাদুর। ভালোবাসা আর যত্ন পেলে বন্যপাখি ও মানুষ হয়ে উঠতে পারে একে অপরের বন্ধু। বনের পাখির সঙ্গে এমন সম্পর্ক বিরল বলে অনেকেই রোমানের প্রশংসা করেন।
রোমানের ছোট ভাই সাইম ছৈয়াল। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, পাখিটি কুড়িয়ে পাওয়ার পর প্রথমে অনেকেই অনেক কথা বলেছে। কিন্তু হাসপাতাল থেকে সুস্থ করে বাড়ি নিয়ে আসার পর লোকজন আরও কটু কথা বলা শুরু করেছিল। বর্তমানে পাখিটি আমাদের বাড়ির একজন সদস্য। ভাইয়া বাসায় না থাকলে আম্মু আর আমি পাখিটি দেখাশোনা করি। গ্রামের লোকজন মাছ ধরলে ভালোবেসে বাহাদুরকে দিয়ে যায়। বাহাদুরের জন্য হিংস্র পাখি, কুকুর কেউই বাড়ির ছোট ছানার কাছে আসতে পারে না। বাহাদুর হিংস্রতা ভুলে আমাদের সবাইকে আপন করে নিয়েছে, আমরাও বাহাদুরকে পরিবারের সদস্য বানিয়েছি।
তোতা মাদবর নামে স্থানীয় একজন ঢাকা পোস্টকে বলেন, রোমান ছোটবেলা থেকেই পশুপাখি প্রেমিক। অসুস্থ বাজপাখিটি ফসলি জমির মধ্যে পেয়ে রোমানকে জানানোর পরে রোমান পাখিটি হাসপাতালে নিয়ে সুস্থ করে তোলে। রোমানের সেবায় সুস্থ হওয়ার পর বাজপাখিটি রোমানের কাছেই থেকে গেছে।
জান্নাতুল ফেরদৌস নুসরাত ঢাকা পোস্টকে বলেন, বারবার ছেড়ে দেওয়া হলেও বাহাদুর চলে যায়নি। সময় মতো বাড়ি এসে খাবার খেয়ে বড় গাছে চলে যায়। বাহাদুরকে গ্রামের সবাই অনেক ভালোবাসে। বাহাদুর গ্রামবাসীর উপকার করে।
গোলবাহার বেগম নামে রোমানের এক প্রতিবেশী ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাজপাখিটি লালন-পালন করায় আমাদের অনেক উপকার হয়েছে। আগে বাড়ির ছোট হাঁস-মুরগির ছানাকে শিকারি পাখি ধরে নিয়ে খেয়ে ফেলত। এখন বাজপাখিটি বাড়ির এসব ছোট ছানাকে রক্ষা করে।
প্রাণীপ্রেমী রোমান ছৈয়াল ঢাকা পোস্টকে বলেন, পাখিটি সুস্থ হওয়ার পর যখন তাকে বনে ছেড়ে দেই, তখন সে আর বনে চলে যায়নি। আমি বুঝতে পারি তার অসুস্থ থাকার সময়ে আমার সেবা তাকে মুগ্ধ করেছে। এরপর তার নাম রাখলাম বাহাদুর। এক সময় পাখিটি বুঝতে পারল তার নাম বাহাদুর। এখন বাহাদুর বলে ডাক দিলেই সে আমার কাছে চলে আসে। বাড়িসহ গ্রামের মানুষের বিভিন্নভাবে উপকার করে সে। গ্রামের মানুষও ভালোবেসে তাকে মাছসহ বিভিন্ন খাবার দেয়। আমাদের জীবনে একে অপরকে অনেক বড় উপকার করার পরও সামান্য বিষয়ের দ্বন্দ্বে আমরা ভুলে যাই যে আমরা বন্ধু। কিন্তু বাহাদুর ভুলে না। বনের পাখিকে বনে ছাড়ার পরও ভালোবাসার টানেই সে আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে আমাদের পরিবারের সদস্য হয়েছে।
শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) ডা. মো. সোহাগ ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাহাদুরকে আমাদের হাসপাতালে নিয়ে এসেছিল রোমান। আমাদের চিকিৎসা ও রোমানের সেবায় বাজপাখিটি সুস্থ্য হয়ে ওঠে। কিন্তু সুস্থ্য হওয়ার পরে বাজপাখিটি বনে ছেড়ে দেওয়া হলেও সে আর বনে যায়নি। রোমানের কাছেই থেকে গেছে। ভালোবাসা পেলে মানুষ ও বনের পশু-পাখিতেও যে বন্ধুত্ব হতে পারে, তার উদাহরণ রোমান আর বাহাদুরের বন্ধুত্ব।
সাইফ রুদাদ/আরএআর