১৮ বছর হেঁটে পত্রিকা বিক্রি করা সোহরাফ পেলেন সাইকেল
সাদাসিধা ও সদা হাস্যোজ্জ্বল প্রকৃতির মানুষ মো. সোহরাফ হোসেন। ১৮ বছর ধরে উপকূলবর্তী এলাকা পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার কুয়াকাটা, আলীপুর, মহিপুর এলাকায় পায়ে হেঁটে পত্রিকা বিক্রি করে আসছেন তিনি। রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে সারা বছরই প্রতিদিন প্রায় ৫-৬শ গ্রাহকের দরজায় হাজির হতে হয় সোহরাফ হোসেনকে। জীবন সংগ্রামে কিশোর বয়স থেকেই এই কঠিন পেশা বেছে নিয়ে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন তিনি। তবে ১৮ বছর পরে এই প্রথম উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি বাইসাইকেল উপহার পেয়ে খুশিতে আত্মহারা পরিশ্রমী হকার সোহরাফ হোসেন।
জীবনের শুরুতে কিশোর বয়স থেকে হাতে খাতা-কলম না নিয়ে, হাতে তুলে নিলেন পত্রিকা আর কাঁধে তুলে নিলেন পরিবারের দায়িত্ব। সাত বছর বয়স থেকে পত্রিকা বিক্রি করতে করতে বয়স এখন ২৫-এর কোঠায়। অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা ও দারিদ্রতায় জর্জরিত তার পরিবার। একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি সোহরাফের পরিবারে রয়েছে বৃদ্ধ মা, স্ত্রী ও তিন সন্তান। জন্মস্থান উপজেলার মুসল্লীয়াবাদ গ্রামে হলেও থাকেন মহিপুর আবাসনে। বাবার রেখে যাওয়া সামান্য একটু জমি থাকলেও মামলা জটিলতার কারণে তাও ভোগ করতে পারছেন না তিনি। বহু বছর ধরে ভাড়া ঘড়ে বসবাস করলেও গত তিন বছর ধরে সরকারের দেওয়া উপহারের ঘড়ে পরিবার নিয়ে থাকছেন। তবে হকারি করে উপার্জন করা টাকায় নিজের সংসার চলছে কোনো রকম টেনেটুনে। এত কষ্ট করে জীবন পরিচালনা করেও সোহরাফ সবসময় হাসিমুখে বলেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ আমি ভালো আছি এবং পরিবারের জন্য সবার কাছে দোয়া চাই।’
সোহরাফ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি যখন ছোট, তখন মাঝে মাঝে স্কুলে যেতাম। পড়াশোনার প্রতি একটা অন্যরকম টান ছিল আমার। কিন্তু সংসারের অভাব-অনটন আমায় খুব পীড়া দিতো। যে কারণে আমি বাড়ির কাউকে কিছু না বলে ২০০৭ সালে স্থানীয় একজন সাংবাদিক মিজানুর রহমানের কাছে কাজের সন্ধানে যাই। উদ্দেশ্য ছিল, তার বাসায় বা দোকানে কর্মচারী হিসেবে কাজ করবো। কিন্তু সাংবাদিক মিজানুর রহমান আমাকে পত্রিকা বিক্রির প্রস্তাব দেন এবং আমি রাজি হয়ে যাই। মাসে ৩০০ টাকা বেতনে কাজ শুরু করি তখন। সপ্তাহে রাজধানী থেকে পত্রিকা আসতো তিন থেকে চার দিন এবং বরিশালের আঞ্চলিক পত্রিকা আসতো প্রতিদিন। এভাবেই শুরু হয় আমার হকারি জীবন। সেই থেকে এখন পর্যন্ত দোকান, বাড়ি এবং বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পেপার পৌঁছে দেওয়ার দ্বায়িত্ব পালন করছি। এরপর প্রতিদিন পত্রিকা বাজারে আসায় বাড়তে লাগলো পত্রিকার কদর। বাড়লো পত্রিকা ও ক্রেতার সংখ্যা। এমনও দিন গেছে চাহিদামতো পত্রিকা দিতে পারিনি কাষ্টমারের হাতে। সেই থেকে পেশা হিসেবে নিয়ে নিলাম হকারের দ্বায়িত্ব। যা আজ পর্যন্ত চলছে।
তিনি আরও বলেন, আগে যখন পত্রিকা বিক্রি করতাম তখন পত্রিকার অনেক কদর ছিল, যেটা বর্তমানে নেই। সকালবেলা যখন পত্রিকা নিয়ে রাস্তায় বের হতাম তখন রাস্তায় বসেই প্রতিদিন ৭০-১০০টি পত্রিকা বিক্রি হয়ে যেত কিন্তু এখন রাস্তায় কোনো পত্রিকা বিক্রি হয় না। বর্তমান সময়ে মানুষের মধ্যে পত্রিকা ক্রয় করার তেমন কোনো আগ্রহ নাই। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে সবার হাতে হাতে স্মার্টফোন। তবে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং বাসাবাড়িতে এখনো পেপার রাখায় আমার সংসার চলছে।
সোহরাফ হোসেন বলেন, পত্রিকা বিক্রি করার সুবাদে প্রতিদিন সকালবেলা উঠে যেতে হয় উপজেলা শহর কলাপাড়ায়। ঢাকা থেকে গাড়িতে আসা পত্রিকাগুলো সংগ্রহ করে আবার ফিরতে হয় কুয়াকাটায়। এজন্য প্রতিদিন ২০ কিলোমিটার পথ যাতায়াত করতে হয়। এতদিন সাইকেল না থাকায় বাসে যাতায়াত করতে হতো এবং বেশিরভাগ সময় বাসের স্টাফরা খারাপ ব্যবহার করতো। এখন আর আমার কোনো কষ্ট হবে না। উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. রবিউল ইসলাম স্যার আমাকে যে সাইকেলটি দিয়েছেন সেটি আমার কাজকে খুব সহজ করে দিয়েছে। স্যারের প্রতি অনেক কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসাও জানান সোহরাফ।
সোহরাফ হোসেনকে নিয়ে কথা হয় স্থানীয় সাংবাদিক কুয়াকাটা প্রেসক্লাবের সভাপতি রুমান ইমতিয়াজ তুষারের সঙ্গে, তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, খুব অল্প বয়সেই পত্রিকা বিক্রির পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করেন সোহরাফ যা ১৮ বছর ধরে চলছে। অনেক কষ্ট করে প্রতিদিন হেঁটে হেঁটে পত্রিকা বিক্রি করতো ছেলেটা। তবে এখন আর হয়তো ওর তেমন একটা কষ্ট হবে না, কারণ এই সাইকেল ওর কষ্ট কিছুটা হলেও কমাবে বলে আশা করছি। তিনি আরও বলেন, হকার সোহরাফ হোসেন যদি পেপার বিক্রি ছেড়ে দেয় তাহলে কুয়াকাটা এলাকায় পেপার আর হয়তো পড়া হবে না। সেজন্য তার ১৮ বছরের পত্রিকা বিক্রির ঐতিহ্য ধরে রাখার প্রয়াসকে সাধুবাদ জানাই আমরা।
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. রবিউল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, কুয়াকাটার স্থানীয় সাংবাদিকদের ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে প্রথমে বিষয়টি অবগত হই। বিষয়টি খুবই দুঃখজনক যে তিনি ১৮ বছর ধরে পায়ে হেঁটে পত্রিকা বিক্রি করছেন।
পত্রিকা বিক্রি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ এবং যেহেতু অনেক বড় একটা এরিয়া নিয়ে তিনি কাজ করেন, তাই তার কষ্টের বিষয়টা উপলব্ধি করতে পারেন বলেও জানান উপজেলা নির্বাহী অফিসার।
তিনি আরও বলেন, আমি ওই ফেসবুক পোস্টেও কমেন্ট করেছিলাম, তার কোনো আপত্তি না থাকলে আমি তাকে সহযোগিতা করতে চাই। মূলত মানবিকভাবেই তাকে সহযোগিতা করার ইচ্ছে হয় এবং পরবর্তীতে যেন সাইকেলে করে পত্রিকা বিক্রি করতে পারেন, এজন্য আমার ব্যক্তিগত তরফ থেকে এ উপহারটি দেওয়া। আমি সোহরাফের পাশে থাকতে পেরে মানসিকভাবে অনেকটা তৃপ্তি পাচ্ছি।
এসএম আলমাস/এএমকে