এভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াই ভালো
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট গণ-অভ্যুত্থানের শেষ দিন ৫ আগস্ট দুপুরে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানার সামনে পুলিশের ছররা গুলিতে আহত হন শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার কিনা চন্দ্র বর্মনের ছেলে খোকন চন্দ্র বর্মন (২৩)। খোকন পেশায় প্রাইভেটকারচালক। একেবারে কাছ থেকে পুলিশের ছররা গুলিতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় খোকনের মুখমণ্ডল। মুখ ছাড়াও পাসহ শরীরের বিভিন্ন অংশে গুলি লাগে খোকনের। বর্তমানে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে (শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট) চিকিৎসা নিচ্ছেন খোকন।
জানা যায়, ছাত্র আন্দোলনের সময় অফিস বন্ধ থাকায় একসঙ্গে আন্দোলনে যুক্ত হন খোকনসহ তার বন্ধু ও সহকর্মীরা। সবাই ৫ আগস্ট যাত্রাবাড়ী থানার সামনে আন্দোলন করার সময় একেবারে কাছ থেকে করা পুলিশের ছররা গুলি খোকনের মুখ ও চোখের নিচের অংশে লাগে। এতে এক চোখ নষ্ট হয়ে যায় তার। আর মুখের এমন অবস্থা হয়েছে যে কেউ চিনতেই পারবে না। আর যে চোখটা ভালো আছে সেটাও এখন উন্নত চিকিৎসার অভাবে নষ্ট হওয়ার পথে। ৫ আগস্ট থেকে এখন পর্যন্ত হাসপাতালের বিছানা তার একমাত্র ঠিকানা। দুই ভাই পরিবারের আয়ের উৎস ছিলেন। খোকন আহত হওয়ার পর থেকে তার বড় ভাই খোকা ছোট ভাইয়ের দেখাশোনা করার জন্য চাকরিটা ছেড়ে দেন। দুই ভাই এক কোম্পানিতে প্রাইভেটকারের চালক ছিলেন।
খোকন চন্দ্র বর্মন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ৫ আগস্ট যাত্রাবাড়ী থানার সামনে পুলিশ আমাকে খুব কাছ থেকে গুলি করে। গুলিতে আমি মাটিতে পড়ে যাই, তবে জ্ঞান হারাইনি। আমাকে ছাত্ররা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায় এবং পরিবারকে ফোন দিয়ে জানায়। আমার মুখের অবস্থা ভালো না, খুব যন্ত্রণা হয়। শুনতেছি উন্নত চিকিৎসার জন্য আমাকে বিদেশ পাঠাবে, কিন্তু তিন মাস হয়ে গেল তেমন অগ্রগতি দেখছি না। আমি আন্দোলনে বেশ কয়েক দিন গিয়েছি, শেষদিন ৫ আগস্ট সকাল ৯টায় বাসা থেকে বের হয়ে আন্দোলনে যাই, দুপুরে আমার গুলি লাগে। দেশকে ভালোবাসি জন্য আন্দোলনে গিয়েছিলাম। আমি আহত হয়েছি এর জন্য আমার কিছু বলার নেই। শুধু সরকারের কাছে আমার একটাই চাওয়া, আমার চিকিৎসার ব্যবস্থাটা যেন করে দেয়।
তিনি আরও বলেন, এভাবে থাকার থেকে মরে যাওয়াই ভালো। এভাবে আমি আর বাঁচতে চাই না, মরে যেতে চাই। কারণ আমি শান্তি পাব।
এভাবেই খুব কষ্টে কথা বলছিলেন গণ-অভ্যুত্থানে গুলিবিদ্ধ খোকন চন্দ্র বর্মন। তার কথাও তেমন স্পষ্ট বোঝা যায় না।
আরও পড়ুন
খোকনের বড় ভাই খোকা চন্দ্র ঢাকা পোস্টকে বলেন, আন্দোলনের পর সরকার বলেছিল যাদের উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু এখনো কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। আমরা এখন কী করব বুঝতে পারছি না। আমরা সরকার থেকে কোনো ধরনের সহযোগিতা পাইনি। মানুষের কাছ থেকে কিছু সহযোগিতা পেয়েছি। এ ছাড়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সারজিস ভাই (সারজিস আলম) এসেছিলেন। তিনি কিছু সহযোগিতা দিয়ে গেছেন। আর কিছু ধারদেনা করে সংসার চলছে। আমার চাকরি ছিল সেটাও চলে গেছে, আমার ভাই এখন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি আছে। খোকনের একটি চোখ পুরোপুরি ড্যামেজ হয়ে গেছে, অলরেডি আরেকটি চোখ ফোলে আছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে চিকিৎসা না করা হলে ওইটার অবস্থাও খারাপ হয়ে যাবে। গুলি চোখ-মুখ-নাক সব জায়গায় লেগেছে। খোকনকে এখন সহজে চেনাই যায় না।
খোকনের মা রিনা রানী দাস ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা ছেলেটা অনেক সুন্দর ছিল। এখন আমিই আমার ছেলের মুখ দেখে চিনতে পারি না। আমার ছেলের মুখের কিছুই আর নেই। আমার ছেলে যখন ভালো ছিল তখন মুখে কিছু পড়লেই একশ বার আয়নার সামনে গিয়ে সেটা দেখত, যাতে করে মুখে কোনো দাগ না লাগে। নিজের শরীরকে অনেক যত্ন করে রাখত। এখন গুলি লাগার পর থেকে অনেক কান্নাকাটি করে, মা হিসেবে আমাকে শুধু বলে মা আমাকে কবে বিদেশ নিয়ে যাবে, কবে আমাকে ভালো করবে, তোমরা সরকারকে বলো তাড়াতাড়ি আমাকে ভালো করতে।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক তানভীর আহামেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাংলাদেশের বিভিন্ন হাসপাতাল এবং আমাদের হাসপাতালের চিকিৎসকরা মিলে খোকনের বেসিক যে অংশগুলো ছিল তার চিকিৎসা আমরা দিয়েছি। তার একটি চোখ ড্যামেজ হয়ে গেছে। আরেকটি চোখ প্রায় ড্যামেজ অবস্থায় ছিল, সেটা আমরা মোটামুটি চিকিৎসা দিয়েছি। তার চোখে চিনের যে হারটা ভেঙে গিয়েছিল সেটা স্টাবল করা হয়েছে। খোকনের উন্নত চিকিৎসার জন্য সেন্ট ভিনসেন্ট হাসপাতাল, মেলবোর্ন চিকিৎসা দিতে সম্মত হয়েছে। তবে এখানে যেহেতু আইনগত বিষয় রয়েছে তার জন্য দেরি হচ্ছে। খোকনের চিকিৎসার জন্য ১০ কোটি টাকার একটি বাজেট দিয়েছে সেন্ট ভিনসেন্ট হাসপাতাল, মেলবোর্ন। তবে খোকনের চিকিৎসা তারা চ্যারিটি হিসেবে নিয়েছে, তাই তার চিকিৎসা বাবদ ৪ থেকে ৫ কোটি টাকা খরচ হতে পারে।
এমজেইউ