চিকিৎসাসেবা নামেমাত্র, খুঁড়িয়ে চলছে ভোলার দক্ষিণ আইচা হাসপাতাল
ভোলা জেলা শহর থেকে সড়ক পথে প্রায় ৮৫ কিলোমিটার দূরে জেলার সর্বদক্ষিণে অবস্থিত চরফ্যাশন উপজেলার দক্ষিণ আইচা থানা। সেখানে চারটি ইউনিয়নে বসবাস করে প্রায় লক্ষাধিক মানুষ। তাদের উন্নত চিকিৎসাসেবার লক্ষে প্রায় ২৬ বছর আগে সৌদি সরকারের সহায়তায় প্রতিষ্ঠিত হয় ২০ শয্যা বিশিষ্ট একটি হাসপাতাল। নানা জটিলতায় বিগত ২৬ বছরেও সেখানকার মানুষের উন্নত চিকিৎসার আশীর্বাদ হতে পারেনি এই হাসপাতালটি।
১৯৯৮ সালে সৌদি সরকারের আর্থিক সহায়তায় দক্ষিণ আইচা থানার বাসস্ট্যান্ড-সংলগ্ন এলাকায় চরমানিক, নজরুল নগর, ঢালচর ও কুকরি মুকরি ইউনিয়নের লক্ষাধিক বাসিন্দাদের উন্নত চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করণের লক্ষে প্রায় ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয় হাসপাতালটি।
২০ শয্যার এ হাসপাতালটিতে রয়েছে তিনতলা বিশিষ্ট একটি আধুনিক ভবন। আন্তঃবিভাগ, জরুরি বিভাগ ও বর্হিবিভাগসহ চিকিৎসক, কর্মকর্তা, নার্স ও কর্মচারীদের জন্য রয়েছে আবাসিক সুবিধা। বর্তমানে হাসপাতালে নামেমাত্র দুইজন চিকিৎসক কর্মরত থাকলেও নেই নার্স, ওষুধ। দীর্ঘদিন ব্যবহার না করায় অকেজো হয়ে পড়েছে চিকিৎসায় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি। এ ছাড়াও গত কয়েক বছর ধরে নেই হাসপাতালে ওষুধ সরবরাহ।
হাসপাতালটিতে চিকিৎসক, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ মোট ৩২টি পদ রয়েছে। প্রজেক্টের মাধ্যমে ১৯৯৮ সালের জুন মাসে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগ হয় এবং ২০০০ সালের দিকে মেডিকেল অফিসার নিয়োগ হলে ২০০১ সালের আগস্ট মাসে চালু হয় বহির্বিভাগ। এরপর ২০০৪ সালে চালু হয় আন্তঃবিভাগ ও জরুরি বিভাগ। যা ২০০৭ সালের দিকে বন্ধ হয়ে যায়।
হাসপাতালটি চালুর পর প্রজেক্টের মাধ্যমে সবকটি পদে জনবল থাকলেও কর্মকর্তা কর্মচারীদের চাকরি রাজস্ব খাতে অন্তর্ভুক্ত না হওয়া এবং প্রজেক্টের মেয়াদ শেষ হওয়ায় প্রথম ধাপে অনেকে চাকরি ছেড়ে চলে যান। এরপর ২০১৩ সালের দিকে হাসপাতালে কর্মরত ১৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী উচ্চ আদালতে একটি মামলা করেন। ২০১৬ সালে উচ্চ আদালত থেকে তারা সে মামলার রায় পেলে তাদের মধ্যেও অনেকে অন্যত্র চলে যান। যার কারণে বর্তমানে ২০ শয্যার হাসপাতালটির ৩২টি পদের মধ্যে বর্তমানে ২৩টি পদই শূন্য রয়েছে।
বর্তমানে চিকিৎসাসেবা কার্যক্রম অনেকটাই বন্ধ হয়ে যাওয়ায় হাসপাতাল ভবনটি একটা ভুতুড়ে ভবনে পরিণত হয়েছে। এই সুযোগে সেখানে মাদক সেবন, ক্রয়-বিক্রয়সহ নিয়মিত জুয়ার আসর বসার অভিযোগ উঠেছে।
সরেজমিনে ২০ শয্যার এ হাসপাতালটি ঘুরে দেখা যায়, ভেতরের দরজা-জানালা ভাঙা। জনবল সংকটের কারণে প্রায় সময় পুরোপুরি বন্ধ থাকে হাসপাতাল। হাসপাতালের মেইন গেট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে দ্বিতীয় তলায় গেলে দেখা মেলে আবাসিক মেডিকেল অফিসারের (আরএমও) কক্ষ। সেখানে তার একটি জরাজীর্ণ নামফলকের দেখা মিললেও তার দেখা মেলেনি। কিন্তু তিনি হাসপাতালে কর্তব্যরত থাকার কথা। এ ছাড়া বর্তমানে কর্মরত ৯টি পদের কর্মকর্তা কর্মচারীদের বিপরীতে মাত্র চারজন কর্মচারীর দেখে মেলে।
আরেকটু সামনে আগালেই দেখা মেলে মেডিকেল অফিসারের কক্ষের। নানান রোগের অসুখ নিয়ে প্রতিদিনের মতো আজও এসেছেন নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির কয়েকজন নারী-পুরুষ ও শিশু। তাই চিকিৎসকের নির্ধারিত কক্ষের সামনেই চেয়ারে বসে আছেন তারা। কিন্তু আজও দেখা পাননি ডাক্তার নামক সোনার হরিণের। ডাক্তারের দেখা না পেয়ে প্রায় দুই ঘণ্টা অপেক্ষার পর এবার বাড়ির পথ ধরেন তারা।
হাসপাতালে চিকিৎসকের অপেক্ষায় থাকা ষাটোর্ধ্ব কৃষক জামাল মিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমি ক্ষেত-খামারে কাম কইররা সংসার চালাই। আমার আর কেউ কামাই করুইন্না (করা) নাই। গত কয়েকদিন অসুস্থ হইয়া বিছানায় পইররা রইছি। আজকে হাসপাতালে আইছি ডাক্তার দেখাইয়া ওষুধ নিতে। দুই ঘণ্টা ধইররা ডাক্তারের রুমের সামনে বইসা রইছি। কিন্তু ডাক্তার এখনো আসেনি। একজনে বলছে ডাক্তারে চরফ্যাশন। তাই এহন বাড়ি চইল্লা যামু। টাকা-পয়সাও নাই যে ভোলা সদর অথবা চরফ্যাশনে গিয়ে ডাক্তার দেখামু।’
একই চিত্র হাসপাতালে আসা অসুস্থ অন্যান্যদেরও, তারা সবাই দরিদ্র। হাসপাতালে এসেছেন বিনামূল্যে ডাক্তার দেখাতে ও ওষুধ নিতে। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে একজন এমবিবিএস, বিএস (স্বাস্থ্য) চিকিৎসক বর্তমানে এ হাসপাতালে সংযুক্ত থাকলেও তিনি হাসপাতালে আসেন না। ব্যক্তিগত চেম্বারে সময় দেন। যা নিয়ে তীব্র ক্ষোভ দেখা দিয়েছে স্থানীয় বাসিন্দাদের মাঝে।
বৃদ্ধ ইয়ানুর বেগম বলেন, আমার শরীরের জয়েন্টে ব্যথা। প্রতিদিন হাসপাতালে আসি ডাক্তার দেখাতে। কিন্তু ডাক্তার পাই না। আজকেও আসছি ডাক্তার দেখাতে। কিন্তু ডাক্তার পাই নাই।
রুমা নামের মধ্য বয়সী আরেক নারী বলেন, ডাক্তার মনে চাইলে হাসপাতালে আসেন। তিনি শুধু ওষুধ লেইখা (লিখে) দেন। এরপর হাসপাতাল থেকে ওষুধ চাইলে দেয় না, বলে হাসপাতালে ওষুধ নাই। পরে ধারদেনা কইরা ওষুধ কিনতে হয়। কি আর করমু?
স্থানীয় বাসিন্দা মো. হাসনাইম, মো. মিরাজসহ আরও কয়েকজন বলেন, যেদিন হাসপাতালটি চালু হইছে সেদিন এই অত্র এলাকার মানুষ ঈদের আনন্দের চেয়েও বেশি আনন্দিত হইছি। কিন্তু এটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর ফের আমাদের দুর্ভোগ শুরু হয়। তা ছাড়া হাসপাতালটি এখন অসামাজিক কার্যকলাপ পরিচালনাকারীদের দখলে। দিনে-রাতে ইয়াবা ও গাঁজার গন্ধে হাসপাতালের সামনের সড়ক দিয়ে যাতায়াত করাটাও এখন আমাদের জন্য দুঃসাধ্য।
তারা আরও বলেন, হাসপাতালটি সেবামূলক কার্যক্রম পুরোপুরি চালু না থাকার কারণে তারা এ সুযোগ পেয়েছেন। প্রশাসন যদি ঠিকমতো নজরদারি করতেন তাহলে তারা হাসপাতালের পরিবেশ নষ্ট করতে পারতো না।
স্থানীয় সচেতন মহলের আব্দুল মান্নান বলেন, এখানকার বেশিরভাগ ভাগ মানুষই সমাজের নিম্ন শ্রেণির। তাদের প্রধান পেশা কৃষি কাজ ও মাছধরা। তারা কেউ গুরুতর অসুস্থ হলে উন্নত চিকিৎসার জন্য চরফ্যাশন উপজেলা শহর ও ভোলা জেলা শহরে জন্য যাবে সেই সামর্থ তাদের নেই। এ অঞ্চলের গরিব-দুস্থ মানুষ যেন স্থানীয় ২০ শয্যার হাসপাতাল থেকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিতে পারেন, সেজন্য প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগের মাধ্যমে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধানের কাছে দ্রুত হাসপাতালটি চালুর দাবি জানান তিনি।
হাসপাতালে অসামাজিক কার্যকলাপ বন্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন কিনা জানতে চাইলে দক্ষিণ-আইচা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ এরশাদুল হক ভূঁইয়া বলেন, আমি এ থানায় নতুন ওসি হিসেবে যোগদান করেছি। মাদকের বিরুদ্ধে আমাদের জিরো টলারেন্স। তদন্ত করে কেউ জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
হাসপাতালটি পুরোপুরি চালুর বিষয়ে ভোলার জেলা প্রশাসক মো. আজাদ জাহানের কাছে জানতে চাইলে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, দক্ষিণ আইচার ২০ শয্যা হাসপাতালে জনবল ও ওষুধ সংকটের কারণে চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হওয়ার বিষয়টি কেউ আমাকে জানাননি। আমি খোঁজ নিচ্ছি।
তিনি বলেন, হাসপাতালটির সমস্যা সমাধানে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও ভোলার সিভিল সার্জনের সঙ্গে কথা বলবো। হাসপাতালটি পুরোপুরি চালুর জন্য যা যা দরকার তা করার চেষ্টা করবো।
এএমকে