‘অপর্যাপ্ত’ সহায়তায় ঋণের ফাঁদে জেলেরা
পিরোজপুর সদর উপজেলার চিথলীয়া গ্রামের জেলে মোবারেক হাওলাদার। নয় মাস বয়সে বাবাকে হারিয়ে মায়ের কাছেই অভাব-অনটনে বড় হয়েছেন। বেঁচে থাকার তাগিদে মাত্র ১২ বছর বয়সে মাছ ধরতে নামেন সাগরে। সেই থেকে ৪০ বছর ধরে সাগরে মাছ ধরে সংসার চালাচ্ছেন তিনি।
সীমাহীন পরিশ্রমের পরও সচ্ছলতার ছিটেফোঁটা নেই সংসারে। যেন অন্তহীন এক সংগ্রামী জীবন। কষ্টের সীমা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায় যখন বন্ধ থাকে সাগরে মাছ ধরা। তখন স্ত্রী-সন্তান নিয়ে মানবেতর জীবন কাটে মোবারেক হাওলাদারের।
শুধু মোবারেক হাওলাদারই নন, তার মতো চিথলীয়া গ্রামের কয়েক শ জেলের প্রতিদিনের সংগ্রামের চিত্র এটি। মাছ ধরাই একমাত্র পেশা হওয়ায় সাগরে নিষেধাজ্ঞা চলাকালে মানবেতর দিন কাটাতে হয় তাদের।
এ সময় অন্য কোনো কাজ করার সুযোগ না পেয়ে পরিবার নিয়ে অলস সময় পার করেন জেলেরা। অনেকে আবার জাল মেরামতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। সঞ্চয় না থাকায় অনেকে এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে সংসার চালান। দিন যত গড়ায় সাগরে ফিরতে না পারায় দুর্বিষহ হয়ে ওঠে জেলেদের জীবন। একদিকে মাছ ধরা বন্ধ, অন্যদিকে নিয়মিত ঋণের টাকা পরিশোধ— যেন অনিঃশেষ অস্থিরতা বিরাজ করে তাদের মধ্যে।
২২ দিন ইলিশ আহরণে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় পরিবারের সঙ্গে অলস সময় পার করেন জেলেরা। অনেকে আবার জাল মেরামতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। সঞ্চয় না থাকায় অনেকে এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে সংসার চালান। দিন যত গড়ায় সাগরে ফিরতে না পারায় দুর্বিষহ হয়ে ওঠে জেলেদের জীবন। একদিকে মাছ ধরা বন্ধ, অন্যদিকে নিয়মিত ঋণের টাকা পরিশোধ— যেন অনিঃশেষ অস্থিরতা বিরাজ করে তাদের মধ্যে
কথা হয় স্থানীয় জেলে মোবারেক হাওলাদারের সঙ্গে। তিনি বলেন, ছোট বেলা থেকে মাছ ধরেই জীবন কাটাচ্ছি। অন্য কোনো কাজ পারি না। মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা থাকলে আমাদের না খেয়ে থাকতে হয়।
মা ইলিশ রক্ষায় সরকার আগামী ১৩ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত ইলিশ আহরণ, পরিবহন, বিপণন ও মজুত বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ সময়ে কী করবেন— জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরকার ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এখন হয়তো আমাদের ২৫ কেজি চাল দেবে। সেই চালে পরিবারের ছয়জনের ১০ থেকে ১২ দিন চলতে পারে। শুধু চাল দিয়েই কি রান্নাবান্না চলে? এর সঙ্গে নিত্যপ্রয়োজনীয় আরও অনেক কিছুর প্রয়োজন হয়। সেগুলো দেবে কে? বাধ্য হয়ে ধার করে সংসার চালাতে হবে।
আরও পড়ুন
মোবারেক হাওলাদারের স্ত্রী আছিয়া বেগম বলেন, মাছ ধরে যে টাকা আয় হয় তা দিয়ে সংসার চালাতেই কষ্ট হয়। পাঁচ মেয়ের চারজনকে ঋণ নিয়ে বিয়ে দিয়েছি। এখন তিন ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে আমাদের সংসার। নিষেধাজ্ঞার সময় যে চাল দেবে তা দিয়ে আমাদের কিছুই হবে না। উল্টো আবারও ঋণ নিতে হবে। প্রতি সপ্তাহে ঋণের দুটা কিস্তি পরিশোধ করা লাগে। নতুন করে ঋণ নিলে সংসার চলবে কীভাবে?
জেলে মো. সুলতান পশারী বলেন, নিষেধাজ্ঞা চলাকালে বেকার সময় পার করতে হয়। সরকার যে চাল দেয় তাতে হয় না, ঋণ করে চলতে হয়। আর কতদিন এভাবে এনজিও থেকে ঋণ করে সংসার চালাব?
মো. আজিজুল পশারী নামের আরেক জেলে বলেন, মাছ ধরাই আমাদের একমাত্র পেশা। অন্য কোনো কাজও পারি না। সরকার এ সময়ে যে চাল দেবে তা দিয়ে সংসার চলবে না। ফের এনজিও থেকে ঋণ নিতে হবে। দিনদিন ঋণের বোঝা ভারী হচ্ছে। কীভাবে শোধ করব জানি না!
আগামী ১৩ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত ২২ দিন ইলিশের প্রজনন মৌসুম। এ সময় সারাদেশে ইলিশ মাছ আহরণ, পরিবহন, মজুত, বাজারজাতকরণ, ক্রয়-বিক্রয় ও বিনিময় নিষিদ্ধ থাকবে
জেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা যায়, আগামী ১৩ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত ২২ দিন ইলিশের প্রজনন মৌসুম। এ সময় সারাদেশে ইলিশ মাছ আহরণ, পরিবহন, মজুত, বাজারজাতকরণ, ক্রয়-বিক্রয় ও বিনিময় নিষিদ্ধ থাকবে। পিরোজপুর জেলায় নিবন্ধিত জেলে রয়েছেন মোট ৩০ হাজার ৭৪৬ জন। তাদের মধ্যে ইলিশ আহরণ করেন এমন পেশাদার জেলে আছেন ২৫ হাজার ২০২ জন। তারা সাগরে গিয়ে মাছ ধরেন।
পিরোজপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা সঞ্জীব সন্নামত ঢাকা পোস্টকে বলেন, সাগরে মাছ ধরা পেশাদার জেলেদের মধ্যে ১৭ হাজার ৭০০ জনকে মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান চলাকালীন জনপ্রতি ২৫ কেজি করে মোট ৪৪২.৫০ টন চাল দেওয়া হবে। যা আমরা ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের অনুকূলে বরাদ্দ দিয়েছি।
পিরোজপুরের বলেশ্বর, সন্ধ্যা, কঁচা ইলিশপ্রবণ এলাকা হওয়ায় ব্যাপক পরিমাণ মা ইলিশ এ সময় ডিম ছাড়ার জন্য সেখানে আসবে। আমাদেরও ব্যাপক পরিমাণ অভিযান ও ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার প্রস্তুতি রয়েছে। যাতে কেউ মা ইলিশ শিকার করতে না পারে— জানান এ মৎস্য কর্মকর্তা।
এসকেডি/এমজে