জমে উঠেছে ৫০০ বছরের পুরোনো ঢাকের হাট, বিক্রি হচ্ছেন বাদকরা
কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীতে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজাকে সামনে রেখে জমে উঠেছে ৫০০ বছরের পুরোনো ঢাক-ঢোল ও বাদ্যযন্ত্রের বিরাট হাট। এটি বাংলাদেশের একমাত্র ঢাকের বাজার। তবে এ হাটে ঢাক বা কোনো বাদ্যযন্ত্র কেনা-বেচা হয় না। বাদ্যযন্ত্র বাদকরা অর্থের বিনিময়ে পূজা চলাকালীন আয়োজকদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন।
মঙ্গলবার (০৮ অক্টোবর) সকাল থেকে শুরু হয়েছে এ হাট। চলবে বুধবার (০৯ অক্টোবর) দুপুর পর্যন্ত। এ হাটে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ঢাক-ঢোলসহ নানা ধরনের বাদ্যযন্ত্র নিয়ে হাজির হয়েছে বাদক দল।
স্থানীয়রা জানান, শারদীয় দুর্গোৎসব ঘিরে চারপাশের আড়ম্বর যা-ই থাক, ঢাক-ঢোলের বাজনা ছাড়া পূজা পূর্ণতা পায় না। ষষ্ঠী থেকে বিসর্জন সবখানে চাই ঢাকের আওয়াজ। এ প্রয়োজন থেকেই প্রায় ৫০০ বছর ধরে কটিয়াদীতে বসছে ঐতিহ্যবাহী এ ঢাকের হাট। কেবল সনাতন ধর্মের নয়, অন্য ধর্মের লোকজনও ভিড় করেন এ হাটে। তাদের কাছে এটি কেবল হাট নয়, হয়ে গেছে সংস্কৃতির অংশও।
এছাড়াও নাম ঢাকের হাট হলেও, এখানে ঢাক বা কোনো বাদ্যযন্ত্র কেনা-বেচা হয় না। বাদ্যযন্ত্র বাদকরা অর্থের বিনিময়ে পূজা চলাকালীন আয়োজকদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন। কার চুক্তি মূল্য কত হবে, তা নির্ধারণ হয় ঢাকিদের দক্ষতার ওপর। পূজা কমিটির কর্তারা যাচাই করে নেন ঢাকিদের দক্ষতা।
স্থানীয়দের দাবি, এ আয়োজন চলছে প্রায় ৫০০ বছর ধরে। অন্যান্য জায়গায় বাদকদল সাধারণত ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যমে চুক্তিবদ্ধ হয় আয়োজকদের সঙ্গে। তবে কিশোরগঞ্জসহ আশপাশের জেলার রীতি কিছুটা ভিন্ন। এ অঞ্চলের পূজা আয়োজকরা ঢাকের হাটে দক্ষতা যাচাই করে মণ্ডপের বাদ্য বাজাতে আমন্ত্রণ জানান বাদকদের।
আরও পড়ুন
প্রায় ৫০০ বছরের পুরোনো ঐতিহ্যবাহী বাদক ও যন্ত্রীদের মিলন উৎসবে ঢাক-ঢোল, কাঁসর, সানাই, বাঁশি, কর্তাল, খঞ্জরিসহ বাঙালির চিরচেনা সব বাদ্যযন্ত্রের পসরা সাজিয়ে হাঁটে বিক্রির উদ্দেশে বাজনা বাজানোর নৈপুণ্য প্রদর্শনের মহড়ায় মেতে ওঠেন বাদক দল।
বিভিন্ন বাদক দলের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কেরানীগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, ঢাকার নবাবগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদীসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে বাদ্যযন্ত্র নিয়ে এ হাটে হাজির হয়েছে অসংখ্য বাদক দল। তাছাড়া বর্তমানে বাদক দলে ঐতিহ্যবাহী বাদ্যের পাশাপাশি যুক্ত হয়েছে আধুনিক বাদ্যযন্ত্রও। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা এসব বাদক দলকে পূজামণ্ডপের জন্য ভাড়া করতেও বিভিন্ন এলাকার পূজারিগণ ভিড় করেন। ১০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত ভাড়ায় মেলে এসব দল।
জনশ্রুতি আছে, ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে স্থানীয় সামন্ত রাজা নবরঙ্গ রায় তার রাজপ্রাসাদে দুর্গাপূজার আয়োজন করতেন। কটিয়াদীর চারিপাড়া গ্রামে ছিল রাজার প্রাসাদ। একবার রাজা নবরঙ্গ রায় সেরা ঢাকিদের সন্ধান করতে ঢাকার বিক্রমপুরের (বর্তমানে মুন্সীগঞ্জ) বিভিন্ন স্থানে আমন্ত্রণ জানিয়ে বার্তা পাঠান। সে সময় নৌপথে অসংখ্য ঢাকির দল পুরোনো ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে যাত্রাঘাটে সমবেত হন। রাজা নিজে দাঁড়িয়ে একে একে বাজনা শুনে সেরা দলটি বেছে নিতেন এবং পুরস্কৃত করতেন। সেই থেকেই এ ঘাটে ঢাকের হাটের প্রচলন শুরু হয়। পরে এ হাট স্থানান্তর করে কটিয়াদীর পুরাতন বাজারের মাছ মহাল এলাকায় আনা হয়।
আরও পড়ুন
গাজীপুরে কাপাসিয়া থেকে সাতজনের বাদক দল নিয়ে এসেছেন সুমন চন্দ্র । তিনি বলেন, ঢোল, বাঁশি, কাসাইসহ বিভিন্ন বাজনা নিয়ে এসেছি। পূজায় সবাই আনন্দ করেন। কিন্তু আমাদের চলে আসতে হয় পরিবার ছেড়ে। বংশ পরম্পরায় এটি হয়ে আসছে। এখানে ২০ থেকে এক লাখ দেড় লাখ টাকায় ঢাকি ভাড়া হয়। আমরাও প্রতিবারের মতো এসেছি।
নরসিংদী থেকে বাদ্য দল নিয়ে এসেছেন মো. তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, আমি একজন শিল্পী মানুষ। প্রায় ৪০ বছর ধরে এ হাটে আসছি। এর আগে বাপ দাদারা আসতেন। এটা আমাদের ব্যবসা। বাংলাদেশে এটিই একমাত্র ঢাকের হাট।
ময়মনসিংহ নান্দাইল থেকে ঢাকি নিতে এসেছেন দুলাল চন্দ্র। তিনি জানান, গত ৮ বছর ধরে এখান থেকে ঢাকি নিয়ে যাই। আমাদের পছন্দ মতো ঢাকি বায়না করে এখান থেকে পূজা উদ্যাপনের জন্য দর দাম করে ঢাকি নিতে পারি।
আরও পড়ুন
ঢাকার বিক্রমপুর থেকে বাদ্যদল নিয়ে এসেছেন সমেণ্ড সরকার। তিনি বলেন, এই হাট থেকে প্রতি বছরই দুর্গাপূজার জন্য ঢাক-ঢোল বায়না করে নিয়ে যায়। আমরা এবারও এসেছি। ১৫ হাজার টাকা থেকে ২৫ হাজার টাকা এবং আরও বেশি টাকায় বায়না করে নিয়ে যায়। আশাকরি এবারও আমরা ভালো দামে যেতে পারবো।
জেলার নীলগঞ্জ থেকে ঢাকির দল ভাড়া করতে এসেছেন রাজন রায়। তিনি বলেন, ঢাকি ছাড়া পূজা জমে না। মায়ের পূজা ঢাকি দিয়ে করতে হয়। আমি গত দুই বছর ধরে এখানে আসছি। আমাদের পূজা উদ্যাপন করতে হলে ঢাকি লাগবেই।
স্থানীয় এলাকাবাসী কৃষ্ণ ধন গোস্বামী বলেন, এই ঢাকের বাজারটি ব্রিটিশ আমল থেকেই হয়ে আসছে। এটি আমাদের ঐতিহ্য, বাংলাদেশে একমাত্র ঢাকের হাট। আমরা এলাকাবাসী হিসেবে তাদের নিরাপত্তায় সব সময় কাজ করি। তাদের যে কোনো সমস্যায় সহায়তায় আমরা এগিয়ে আসি।
কটিয়াদী পৌর পূজা উদ্যাপন পরিষদের সেক্রেটারি জনি কুমার সাহা জানান, ঢাকের হাট কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীর একটি ঐতিহ্য। এটাই হচ্ছে বাংলাদেশের একমাত্র ঢাকের হাট। শারদীয় দুর্গোৎসবকে সামনে রেখে এ বাদ্যযন্ত্রের হাট বসে। কিন্তু চিরচেনা তাল ও সুরের প্রদর্শনের মহড়ায় প্রকৃতপক্ষে এটি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালির মিলনমেলায় পরিণত হয়। সব ধর্মের লোকজনই হয়ে ওঠে ওদের রক্ষাকবচ। হাটে বাদ্য দলের জন্য থাকা খাওয়ার ব্যবস্থাসহ সব সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে। প্রতি বছর এখানে প্রায় ৫০০ থেকে ৬০০ ঢাকি এই হাটে আসেন। যারা অবিক্রীত থাকেন হাট কর্তৃপক্ষ থেকে তাদের বাড়ি যাওয়ার ভাড়া দিয়ে দেওয়া হয়। তবে অন্যবারের তুলনায় এবার ঢাকি সংখ্যা কম।
আরও পড়ুন
কটিয়াদী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, নিরাপত্তার কাজে সার্বিক তদারকি করা হচ্ছে। পূজার আয়োজক ও বাদকদের নিরাপত্তার জন্য কটিয়াদী মডেল থানা পুলিশ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছে। ঢাকের হাটে পুলিশের একটি মোবাইল টিম কাজ করছে।
কটিয়াদীতে ঢাকের হাটে আসা বাদকদলের থাকা-খাওয়া, নিরাপত্তাসহ যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করে স্থানীয় পূজা উদ্যাপন পরিষদ ও উপজেলা প্রশাসন। তবে বাদকরা জানান, এসব যথেষ্ট না। সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হলে আরো জমজমাট হবে এই ঢাকের হাট।
মোহাম্মদ এনামুল হক হৃদয়/এফআরএস