সেই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের স্ত্রীও বরখাস্ত, তদন্ত কমিটি গঠন
রংপুরের তারাগঞ্জে একটি বিদ্যালয়ে এক পরিবারের সাতজনের নিয়োগসহ আরও বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে সাময়িক বরখাস্ত হওয়া বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষকের স্ত্রী আলেয়া বেগমকে সহকারী প্রধান শিক্ষকের পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। বুধবার (২ অক্টোবর) তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। একইসঙ্গে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এর আগে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আলিয়ার রহমান ও তার স্ত্রী আলেয়া বেগমের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ করেন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা। এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত ২২ সেপ্টেম্বর প্রধান শিক্ষককে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, আধিপত্য বিস্তারের জন্য গোপনে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আলিয়ার রহমান নিয়মনীতি না মেনে তার স্ত্রী, ভাই, ভাতিজা এবং ভাতিজার বউকে চাকরি পাইয়ে দিয়েছেন। এরপর যৌথভাবে অনিয়ম-দুর্নীতি করছেন। রংপুর শহরে বিলাসবহুল বাড়ি, গ্রামে কোটি টাকার জমি কিনেছেন আলিয়ার রহমান।
বিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৫ সালে উপজেলার কুর্শা ইউনিয়নের বড়গোলা এলাকায় ঘনিরামপুর বড়গোলা উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৯৬ সালে ওই বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান আলিয়ার রহমান। এরপর তার বড় ভাই মফিজাল রহমানকে কৌশলে ওই বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি করেন।
স্থানীয় ও অভিভাবকদের অভিযোগ, প্রধান শিক্ষক আলিয়ার রহমান ও সভাপতি মফিজাল মিলে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে গোপনে ভাই, ভাতিজা, ভাতিজার বউকে নিয়োগ পাইয়ে দেন। ২০০০ সালে প্রধান শিক্ষকের স্ত্রী আলেয়া বেগম বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। ২০০৪ সালে ভাতিজা আজম আলী, ২০১৬ সালে ভাতিজার স্ত্রী মোরশেদা বেগমকে সহকারী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এরপর ২০২২ সালে আরেক ভাতিজা আজমির সরকারকে পিয়ন ও ভাতিজার স্ত্রীকে মালি পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০২৩ সালে আরেক ভাতিজাকে ঝাড়ুদার পদে নিয়োগ দেন প্রধান শিক্ষক।
এদিকে স্বামী প্রধান শিক্ষক হওয়ায় সহকারী প্রধান শিক্ষক আলেয়া বেগম নিয়মিত স্কুলে আসেন না। নিজ স্বামী আলিয়ার রহমান ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও স্বামীর বড় ভাই মফিজাল হোসেন স্কুল প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকে সভাপতি থাকায় নিয়মনীতির কোনো তোয়াক্কা না করে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও বিদ্যালয়ের কর্মচারীদের ওপর একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। স্বামীর বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির পক্ষে অবস্থান নেন এবং নিজেও সেই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। সপ্তাহে একদিন বিদ্যালয়ে এসে তিনি শিক্ষক হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করেন। মাঝেমধ্যে প্রধান শিক্ষকও ওই হাজিরা খাতায় স্ত্রীর হয়ে স্বাক্ষর করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই বিদ্যালয়ের এক সহকারী শিক্ষক ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রধান শিক্ষকের স্ত্রী হওয়ার সুবাদে সহকারী প্রধান শিক্ষক সপ্তাহে এক-দুই দিন বিদ্যালয়ে আসেন। কিছু বললে শিক্ষকদের লাঞ্ছিত করেন। নানা অজুহাতে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টাকা আদায় করেন। প্রতিবাদ করলে লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়। প্রধান শিক্ষক কথায় কথায় চাকরি ছেড়ে চলে যাওয়ার হুমকি দিতেন।
ওই বিদ্যালয়ের ৯ম শ্রেণির শিক্ষার্থী আহাদ শেখ ঢাকা পোস্টকে বলে, সহকারী প্রধান শিক্ষক আলেয়া খাতুনের বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। তিনি এত বেশি অনিয়ম করেছে যে, সারাদিন বললেও তা শেষ হবে না। আমাদের সোনার বাংলাদেশে কোনো দুর্নীতিবাজের স্থান নেই। আমরা শিক্ষার্থীরা নতুন এক বাংলাদেশ উপহার দিতে চাই। ওই সহকারী প্রধান শিক্ষকের আমরা স্থায়ী বরখাস্ত চাই।
ওই বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী নজির হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, চরম দুর্নীতি করেছেন উনি। তারা এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিকে পারিবারিক ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে রূপ দান করেছেন। আমাদের অজপাড়াগাঁয়ের ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিকে বাঁচাতে হলে ওদের পরিবারতন্ত্রের হাত থেকে বাঁচাতে হবে। দুর্নীতিবাজদের স্থায়ী বরখাস্ত করতে হবে।
তারাগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রুবেল রানা ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিভিন্ন অভিযোগ এনে ওই বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক আলেয়া খাতুনের বিরুদ্ধে ওই বিদ্যালয়ের প্রাক্তন, বর্তমান শিক্ষার্থী ও অভিভাবকগণ আমার কাছে লিখিত অভিযোগ দেন। তার প্রেক্ষিতে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে এবং তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এর আগে গত ২২ সেপ্টেম্বর বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
শরিফুল ইসলাম/এমজেইউ