বাহারের প্রভাবে অস্ত্রের লাইসেন্স পেয়েছিলেন ৩ ডজন অনুসারী
আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১৫ বছরের ক্ষমতার আমলে কুমিল্লায় অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রেও ব্যাপক দলীয়করণ করা হয়েছিল। ক্ষমতার প্রভাব খাটাতে সাবেক সংসদ সদস্য, উপজেলা চেয়ারম্যান, মেয়র, সিটি কাউন্সিলর, পৌর মেয়র ও পৌর কাউন্সিলরসহ বিভিন্ন পর্যায়ের আওয়ামী লীগ নেতাদের দেওয়া হয়েছিল অস্ত্রের লাইসেন্স।
তবে জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি অস্ত্রের লাইসেন্স পেয়েছিলেন কুমিল্লা-৬ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দীন বাহারের অনুসারীরা। আওয়ামী লীগের এই নেতা ও চারবারের সাবেক সংসদ সদস্যের অন্তত তিন ডজন অনুসারী অস্ত্রের লাইসেন্স পেয়েছিলেন গত ১৫ বছরে।
জেলা প্রশাসনের একটি সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
আরও পড়ুন
সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত বেসামরিক জনগণকে জেলার ১৮ থানায় ২০৯টি অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া হয়। তার মধ্যে ১৫ জন অস্ত্র কেনেননি। বাকি ১৯৪ জন অস্ত্র কেনেন। তাদের মধ্যে ৯ জন ছাড়া সবাই সরকার নির্ধারিত সময় ৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সংশ্লিষ্ট থানায় অস্ত্র জমা দিয়েছেন। অস্ত্র জমা না দেওয়া এই ৯ জনের মধ্যে বাহার ও তার মেয়ের জামাই সাইফুল আলম রনি রয়েছেন। এছাড়াও চৌদ্দগ্রামের কাশিনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা মোশারেফ হোসেনও আছেন এই তালিকায়। তবে অস্ত্র জমা না দেওয়া বাকিদের নাম জানা যায়নি।
সূত্রটি জানিয়েছে, সদর আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার একাই তার সমর্থিত নেতাকর্মী, ব্যবসায়ী, দলীয় ক্যাডার ও অনুসারীদের জন্য তিন ডজনেরও বেশি পিস্তল, শটগান ও বন্দুকের লাইসেন্স বাগিয়ে নেন।
সাবেক সংসদ সদস্য বাহার নিজে ২০১৩ সালে শটগানের লাইসেন্স নেন। ২০২১ সালে পিস্তলের লাইসেন্স নেন বাহারের বড় মেয়ে ও কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের (কুসিক) সাবেক মেয়র তাহসীন বাহার সূচনার স্বামী সাইফুল আলম রনি।
এছাড়াও বাহারের অনুসারীদের মধ্যে লাইসেন্স পাওয়া উল্লেখযোগ্যরা হলেন- সিটি কর্পোরেশনের প্রয়াত মেয়র আরফানুল হক রিফাত, আদর্শ সদর উপজেলার অপসারিত চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম টুটুল, মহানগর যুবলীগের আহ্বায়ক ও অপসারিত জেলা পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ সহিদ (জিএস সহিদ), সিটি কর্পোরেশনের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের বিতর্কিত কাউন্সিলর ও হত্যা মামলার আসামি সৈয়দ রায়হান আহমেদ, মহানগর আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ আলী মনসুর ফারুক, ১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা আবুল হোসাইন ছোটন, শফিউল আলম, আইয়ুব আলী ভূইয়া, কাউছার খন্দকার, মো. রাশেদুজ্জামান, চঞ্চল কুমার ঘোষ, নগরীর ২২ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল মালেক ভূইয়া, ইউপি চেয়ারম্যান সেকান্দর আলী, সদর উপজেলার সাবেক উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান আহাম্মেদ নিয়াজ পাভেল, বাহারের দলীয় ক্যাডার হিসেবে পরিচিত ও মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক সাদেকুর রহমান পিয়াস, কুসিকের প্যানেল মেয়র ও বাহারের ভাতিজা হাবিবুর আল আমিন সাদী, মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা জসীম উদ্দিন প্রমুখ।
গত ৫ আগস্ট ছাত্রজনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর এসব নেতাদের অধিকাংশই আত্মগোপনে চলে গেছেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঘটনায় গুলি চালিয়ে হত্যা ও আহত করার বেশ কয়েকটি মামলায় আসামি হয়েছেন বাহারের অধিকাংশ অনুসারী।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলা প্রশাসনের এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, জীবনের ঝুঁকি থাকলে এবং বছরে ন্যূনতম দুই লাখ টাকা আয়কর রিটার্ন জমা, পুলিশের বিশেষ শাখার (ডিএসবি) প্রতিবেদন, অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনসহ বিভিন্ন শর্ত পূরণ করে কোনো ব্যক্তি লাইসেন্স পাওয়ার আবেদন করতে পারেন। তবে সাবেক সংসদ সদস্য বাহাউদ্দিন বাহারের এসব অনুসারীরা কৌশলে বেশি রিটার্ন দাখিল দেখিয়ে অস্ত্রের লাইসেন্স নিয়েছেন। পুলিশ প্রতিবেদন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্র ছাড়াই বাহাউদ্দিন বাহারের বিশেষ তদবিরে তার এসব অনুসারীরা অস্ত্রের লাইসেন্স পেয়েছিলেন।
ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, নিয়মানুযায়ী সব শর্ত পূরণ সাপেক্ষে একজন ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ দুটি আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া হয়। বিগত সময়ে দেওয়া অধিকাংশ আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স দলীয় তদবীরে দেওয়া হয়েছিল। সেক্ষেত্রে অনেক শর্তই মানা হয়নি। তারা লাইসেন্স পেয়েছিলেন শুধুমাত্র বাহারের বাহারি কেরামতিতে।
কুমিল্লার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) সৈয়দ শামসুল তাবরীজ বলেন, আগে কে কীভাবে অস্ত্রের লাইসেন্স পেয়েছিলেন সেটি নিয়ে আমার কিছু বলার নেই। তবে সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট থানায় লাইসেন্স নেওয়া প্রায় সব আগ্নেয়াস্ত্র জমা হয়েছে। দুটি অস্ত্র লুট হওয়ার জিডি হয়েছে। এসব বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে তা সরকার সিদ্ধান্ত নেবে।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও সহকারী অধ্যাপক মু. আবু বকর সিদ্দিক বলেন, অস্ত্রের লাইসেন্সের বিষয়টি খুব সংবেদনশীল। সরকারিভাবে যথাযথ যাচাই-বাছাই না করে কোনো ব্যক্তিকে যদি লাইসেন্স দেওয়া হয় তা রাষ্ট্র ও নাগরিক জীবনের জন্য হুমকি। তাই অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষকে আরও কঠোর হতে হবে।
আরিফ আজগর/জেডএস