জন্মসনদ নেই বেশিরভাগ পথশিশুর, ভর্তি হতে পারছে না স্কুলে
সাত বছর ধরে ফেনী শহরের রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় থাকছে শুক্কুর। মা-বাবা দুজনই বিচ্ছেদের পর বিয়ে করেছে অন্যত্র। তারপর থেকে কখনো ভিক্ষাবৃত্তি আবার কখনো অপরাধমূলক কাজে যুক্ত হয়ে জীবন কাটছে তার।
শুক্কুর ঢাকা পোস্টকে বলেন, অন্যদের মতো আমারও পড়াশোনা করা এবং মা-বাবার সঙ্গে থাকার ইচ্ছে হয়। কিন্তু আমার জন্য তো এখন আর কেউ নেই। সারাদিন নিজের মনের মতো চলাফেরা করি। কোনো কিছুতে বাধা দেওয়ারও কেউ নেই।
পৌরসভার সহদেবপুর এলাকার শিশু সাইমুনের বাবা জামাল উদ্দিন বলেন, খুলনা থেকে এসে অনেক বছর ধরে এখানে আছি। শহরে রিকশা চালিয়ে পরিবার নিয়ে বসবাস করছি। স্থানীয় বাসিন্দা না হওয়ার কারণে এনআইডি করতে পারিনি। কয়েকবার চেষ্টা করে সন্তানের জন্মনিবন্ধন সনদও করতে পারিনি। ছেলেকে বিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে গিয়ে এ জটিলতায় ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসতে হয়েছে। ছিন্নমূল হয়ে আছি, আমাদের একটা পরিচয় নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকারও নেই।
একই ধরনের অভিযোগ শহরের শত সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পথশিশুদের অধিকার ও সুরক্ষার ব্যাপারে রাষ্ট্রের উদ্যোগ গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি। অপরাধ জগত থেকে ফেরাতে হলে ভাসমান পথশিশুদের মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত করা জরুরি।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, ফেনী শহরের বেশিরভাগ পথশিশুর জন্মনিবন্ধন সনদ নেই। যে কারণে তারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারে না। এছাড়া তাদের বড় একটি গোষ্ঠী বঞ্চিত হচ্ছে নাগরিক সুবিধা থেকেও।
দেখা গেছে, শিশুর বাবা-মায়ের পরিচয় ও ঠিকানা না থাকা, শিশুর ধর্ম নির্ধারণ করতে না পারা, নিবন্ধন নিয়ে শিশুর বাবা-মায়ের অজ্ঞতাসহ নানা কারণে নিবন্ধন করা হয়ে ওঠে না। যারা পথশিশু তাদের অনেকের পরিচয় ও বাসস্থান নেই। আর শুরুতে বাবা-মায়ের নাম না দিলে সার্ভারে প্রবেশ করা যায় না।
এ ব্যাপারে সহদেবপুর খায়রুন্নেছা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আলমগীর হোসেন বলেন, প্রাথমিকে যেকোনো শিক্ষার্থী নতুন ভর্তির ক্ষেত্রে প্রথমেই জন্মনিবন্ধন প্রয়োজন হয়। এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনাও রয়েছে। সেজন্য এ প্রক্রিয়ার বাইরে গিয়ে কাউকে ভর্তির সুযোগ দেওয়া সম্ভব হয় না।
জেলায় পথশিশুদের নিয়ে সরকারিভাবে কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও ফেনীর বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও সংশ্লিষ্টদের দেওয়া তথ্যমতে, এখানকার পথশিশুদের বেশিরভাগ লাকসাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, খুলনা, লক্ষ্মীপুর, চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী থেকে এসেছে। সড়ক পথে যাতায়াত এবং আবাসনের জন্য তুলনামূলক সুবিধাজনক হওয়ায় এখানে ভাসমান শিশুরা সহজে জায়গা করে নেয়। তবে তারা একই স্থানে দীর্ঘসময় স্থায়ী হয় না।
জেলা স্বেচ্ছাসেবক পরিবার প্ল্যাটফর্মের কর্মী নিষাদ আদনান বলেন, পথশিশুদের নিয়ে সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তর বা তেমন কারো কাছে নির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান নেই। বরাবরই এ গোষ্ঠী উপেক্ষিত থাকে। কাজ করতে গিয়ে তাদের সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতা হয়েছে। তাদের মধ্যে ৫০ শতাংশের বেশি শিশু মাদকাসক্ত, ২০ শতাংশ চুরি-ছিনতাইয়ে জড়িত, ৪০ শতাংশের বিছানা নেই। এসব শিশুদের অনেকের মা-বাবা থাকলেও পারিবারিক ঝামেলায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পথেঘাটে থাকতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, ফেনী শহরের পথশিশুদের জন্য কয়েক বছর আগে রেলওয়ে স্টেশন প্লাটফর্মে একটি শিক্ষা কার্যক্রম করা হতো। সরকারি সহায়তা না পাওয়ায় তা পরবর্তীতে বন্ধ হয়ে গেছে। শহরের মধ্যে রেলওয়ে স্টেশন, মহিপাল, বিভিন্ন বস্তি, ভাঙারি দোকান ও বাসস্টপেজগুলোতে সবচেয়ে বেশি পথশিশুর অবস্থান রয়েছে।
পথশিশুদের জন্মনিবন্ধন প্রক্রিয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ফেনী পৌরসভার স্যানিটারি ইন্সপেক্টর ডা. কৃষ্ণপদ সাহা বলেন, শিশুর টিকা কার্ড ও মা-বাবার এনআইডি নিয়ে এলে জন্মনিবন্ধন সনদ দেওয়া হচ্ছে। ভাসমানদের বিষয়ে বিশেষ কোনো নিয়ম নেই।
পথশিশুর তথ্য নেই কোনো দপ্তরে
সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পুনর্বাসন ও জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রতিবছরের ২ অক্টোবর পালিত হয় বিশ্ব পথশিশু দিবস। এ শ্রেণির শিশুদের উন্নয়নে সরকার নানাবিধ পরিকল্পনা গ্রহণ করলেও ফেনীর পথশিশুদের তথ্য সংগ্রহে কোনো উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়নি। জেলার সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে নেই এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জেলা মহিলা ও শিশু অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক নাসরিন আক্তার বলেন, পথশিশু বা সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের বিষয়ে আমাদের কোনো পরিসংখ্যান নেই। এটি সমাজসেবা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সমাজসেবা অধিদপ্তর দেখছে।
জেলা পরিসংখ্যান ব্যুরোর উপ-পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মো. তানজীব হাসান ভূঁইয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, স্থানীয়ভাবে ভাসমানদের বিষয়ে এ ধরনের কোনো তথ্য নেই। ২০২২ সালের সর্বশেষ জনশুমারিতেও ভাসমান শিশুদের ব্যাপারে কোনো তথ্য আসেনি।
এ ব্যাপারে সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সাইফুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, সমাজসেবা দপ্তর থেকে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে এ ধরনের কোনো পরিসংখ্যান নেই। সরকারি সহায়তা পেতে হলে অন্তত জন্মনিবন্ধন বা এনআইডি থাকতে হয়। যার কোনোটিই তাদের থাকে না। এজন্য তারা ঠিকমতো নাগরিক সুবিধাও পান না।
চাহিদা না মেটালে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে আচরণে
ভাসমান পথশিশুদের মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত করা গেলে সমাজের অপরাধজগত থেকে তাদের ফেরানো সম্ভব বলছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের প্রাক্তন অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ওবায়দুল করিম।
তিনি বলেন, সমাজ উন্নয়নের সঙ্গে মধ্যবিত্তের সংখ্যা বাড়লে দারিদ্র্য কমে যাবে। তখন পথশিশুর সংখ্যাও কমবে। তবে এ সংক্রান্ত পরিসংখ্যান থাকা জরুরি।
চাহিদাগত দিক আচরণকে প্রভাবিত করে উল্লেখ করে অধ্যাপক ওবায়দুল করিম বলেন, চাহিদা না মেটালে আচরণগত দিক থেকে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এ শ্রেণির শিশুরা তখন শিশুশ্রম অথবা ভিক্ষাবৃত্তিতে জড়িয়ে পড়ে। পরবর্তী অনেকে অপরাধ জগতের অংশ হয়ে যায়।
আরকে