নিঃসঙ্গ আর অবহেলিত জীবন, নেই সামাজিক নিরাপত্তা
২০১৯ সালে চাকরি থেকে অবসরে যান ফেনীর ব্যাংক কর্মকর্তা মো. আবুল কালাম চৌধুরী। তিন মেয়ের আগেই বিয়ে হওয়ায় কয়েক বছর ধরে বাড়িতে শুধু স্বামী-স্ত্রী দুজনের বসবাস। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা দুইজনই আক্রান্ত হচ্ছেন নানা রোগব্যাধিতে। তার সঙ্গে রয়েছে নিঃসঙ্গতা। ভারাক্রান্ত শরীর আর একাকিত্ব যেন আরও হতাশ করে তুলছে তাদের।
মো. আবুল কালাম চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখন চাইলেও আর কোনো কাজ করতে পারি না। ছেলেমেয়েরা যে যার মতো করে কর্মব্যস্ত। বাসায় বসে অলস সময় কাটানো বেশি কষ্টকর।
শহরের মাস্টারপাড়ার বৃদ্ধা যমুনা প্রভা বণিক। বয়স ৭০ বছরের বেশি। তিনি বলেন, ২২ বছর আগে স্বামী মারা যাওয়ার পর তিন ছেলে ও দুই মেয়েকে প্রতিষ্ঠিত করে বিয়ে দিয়েছি। বর্তমানে শহরে বড় ছেলের বাসায় থাকছি। কিন্তু এখানে নাতি-নাতনিরা পড়াশোনার জন্য ঢাকায় থাকে। চাকরির জন্য ছেলেকেও কাছে পাওয়া হয় না। একটু কথা বলা বা নিজের অসুস্থ শরীরের দেখাশোনার জন্য কাউকে কাছে পাওয়া যায় না। সবমিলিয়ে এ বয়সে এসে এমন পরিস্থিতি সামলে ওঠা কঠিন হয়ে পড়েছে।
এমন একই গল্প সমাজের বিভিন্ন স্তরে বসবাসরত প্রায় প্রত্যেক প্রবীণের। নিজেদের আর্থিক নিরাপত্তা, বিনোদন, পারিবারিক যত্নসহ নানা বিষয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন ফেনীর প্রবীণরা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে মানুষের গড় আয়ু ৭২ দশমিক ৩ বছর। শতায়ু বেঁচে থাকার সৌভাগ্য খুব একটা বেশি মানুষের হয় না। ২০২২ সালের জনশুমারির প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ফেনীতে শতায়ু ও তদূর্ধ্ব বয়সী মানুষ রয়েছেন ৩৬০ জন। তাদের মধ্যে পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যা বেশি। জেলায় শতায়ু লাভ করা পুরুষের সংখ্যা ১৩৩ জন, যা মোট সংখ্যার ৩৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ। আর নারীর সংখ্যা ২২৭ জন, যা মোট সংখ্যার ৬৩ দশমিক ৬ শতাংশ।
২০২২ সালের জনশুমারি হতে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, জেলায় মোট জনসংখ্যা ১৬ লাখ ৪৮ হাজার ৮৫২ জন। তাদের মধ্যে ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তির সংখ্যা ১ লাখ ৫৯ হাজার ৫২৮ জন, যা মোট জনসংখ্যার ৯ দশমিক ৬৮ শতাংশ। এতে পুরুষ রয়েছেন ৮২ হাজার ৫৮৯ জন ও নারী ৭৬ হাজার ৯৩৯ জন।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, জেলায় প্রবীণদের মধ্যে পরনির্ভরশীলতার হার রয়েছে উল্লেখযোগ্য। ৬৫ বছর বয়সের ঊর্ধ্বে প্রবীণদের সংখ্যা ১ লাখ ৫ হাজার ২২৯ জন। তাদের মধ্যে ৬২ হাজার ৩৮৩ জন পরিবারের ওপর নির্ভরশীল। এ প্রবীণ জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশ পরিবার ও সমাজ থেকে অবহেলা আর উপেক্ষার শিকার হচ্ছেন।
দাগনভূঞা মাতুভূঞা ইউনিয়নের মোমারিজপুর গ্রামের বাসিন্দা মোহাম্মদ মোস্তফা ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার বয়স ৬৭ পার হয়েছে। প্রতিদিন ঘরের মধ্যে বসে থাকা ছাড়া তেমন কোনো কাজ নেই। এলাকার তরুণরা যেভাবে নিজেদের মতো করে সময় কাটায় আমাদের জন্য তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। বয়স্ক মানুষদের কথা বিবেচনা করে সরকার যদি কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেন তাহলে অন্তত অলস সময়গুলো ভালোভাবে কাটাতে পারব।
জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের তথ্য মতে, ফেনীতে মোট ৪৮ হাজার ৮৪৮ জন মাসিক ৬০০ টাকা করে বয়স্ক ভাতা পেতেন। তবে এখন ভাতা কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। ভাতাভোগীদের নিয়েও রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। প্রবীণদের কেউ কেউ অভিযোগ করছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে যাদের সুসম্পর্ক ছিল তারাই মূলত ভাতা পেয়ে এসেছেন।
সমাজসেবা কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ভাতা প্রদানের ক্ষেত্রে যারা আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল অথবা পরিবারে আয়ের উৎস না থাকলে তাদের ভাতার জন্য যোগ্য বলে বিবেচনা করা হত। সেক্ষেত্রে পুরুষদের বয়স ৬৫ বছর এবং মহিলাদের বয়স ৬২ বছরের বেশি হওয়ার বিধান ছিল।
জেলার পরশুরাম উপজেলার বীরচন্দ্র নগর এলাকার ষাটোর্ধ্ব জিলু মিয়া বলেন, পরিবারে আয়ের কোনো উৎস নেই। নিজেরও কিছু করার সক্ষমতা নেই। আমার বয়সের অন্যরা বয়স্ক ভাতা পান, কিন্তু তাদের পরিবারের আয়ের উৎস রয়েছে। আর আমার আয়-রোজগার নেই, তারপরও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে শুধু সুসম্পর্ক না থাকায় ভাতা পাইনি।
এ ব্যাপারে জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সাইফুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, দাপ্তরিকভাবে প্রবীণদের নিয়ে কাজ করার পরিকল্পনা রয়েছে। ইতোমধ্যে রাজধানীতে প্রবীণদের জন্য হাসপাতাল ও তাদের কল্যাণে প্রবীণ হিতৈষী সংঘ গড়ে তোলা হয়েছে। এছাড়া অসহায় ও দুস্থ ষাটোর্ধ্ব বয়োবৃদ্ধদের জন্য বয়স্কভাতার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
ভাতা কার্যক্রমের বিষয়ে উপ-পরিচালক বলেন, সাধারণত স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বয়স্কভাতার জন্য তালিকা তৈরি করেন। এক্ষেত্রে বিভিন্ন সময় স্বজনপ্রীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। তবে চাইলে তারা নিজেই অনলাইনে আবেদন করতে পারেন। আমরা উপকারভোগীদের তথ্য হালনাগাদ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে প্রেরণ করি। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ সরাসরি ভাতার টাকা উপকারভোগীদের মোবাইল ব্যাংকিয়ের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেন।
প্রসঙ্গত, ১৯৯০ সালে জাতিসংঘ প্রতিবছর ১ অক্টোবর আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। প্রবীণদের সুরক্ষা এবং অধিকার নিশ্চিতের পাশাপাশি বার্ধক্যের বিষয়ে বিশ্বব্যাপী গণসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ১৯৯১ সাল থেকে দিবসটি পালন করা শুরু হয়।
আরকে