আকস্মিক বন্যায় পানিবন্দি লক্ষাধিক মানুষ, ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শঙ্কা
ভারতের উজান থেকে নেমে আসা ঢল আর টানা বৃষ্টির পানিতে ফুলে-ফেঁপে উঠেছে উত্তরের নদ-নদীগুলো। বিশেষ করে তিস্তা, ঘাঘট, যমুনেশ্বরী, করতোয়া, ধরলা, দুধকুমার ও ব্রহ্মপুত্রসহ অসংখ্য নদ-নদী বিধৌত রংপুর অঞ্চলের পাঁচ জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হতে শুরু করেছে। কোথাও কোথাও তিস্তার পানি বিপৎসীমা উপচে নদী তীরবর্তী চরাঞ্চল ঢুকে পড়েছে। স্বল্প মেয়াদি বন্যার সঙ্গে দেখা দিয়েছে নদী ভাঙনের আশঙ্কা।
পানি বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে উঠতি আমন ধান ও শীতকালীন শাক-সবজির ক্ষেতসহ ডুবেছে বিভিন্ন ফসলি জমি। প্রভাব পড়েছে গ্রামীণ যোগাযোগ ব্যবস্থার পাশাপাশি রেলপথেও। রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী ও গাইবান্ধা জেলার নদ-নদীর কূলঘেঁষা চর ও চরদ্বীপসহ লোকালয়ের লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, রোববার রাত ৯টার দিকে রংপুরে তিস্তা নদীর কাউনিয়া পয়েন্টে পানির প্রবাহ রেকর্ড করা হয় ২৯ দশমিক ৫৮ সেন্টিমিটার। যা (স্বাভাবিক ২৯ দশমিক ৩১ সেন্টিমিটার) বিপৎসীমার ২৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এর আগে একই পয়েন্টে সন্ধ্যা ৬টায় পানির প্রবাহ বিপৎসীমার ৩১ এবং বিকেল ৩টায় বিপৎসীমার ৩৩ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়েছে। এ দিন দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ডালিয়া পয়েন্টে সন্ধ্যা ৬টায় পানির প্রবাহ রেকর্ড করা হয় ৫১ দশমিক ৯৫ সেন্টিমিটার। যা (স্বাভাবিক ৫২ দশমিক ১৫ সেন্টিমিটার) বিপৎসীমার ২০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে হয়। বিকেল ৩টায় একই পয়েন্টে পানির প্রবাহ বিপৎসীমার ৮, দুপুর ১২টায় বিপৎসীমার ৩, সকাল ৯টায় বিপৎসীমার ১ সেন্টিমিটার নিচ এবং সকাল ৬টায় বিপৎসীমার ২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। গত ৮ ঘণ্টায় (সন্ধ্যা ৬টার আগ পর্যন্ত) উজানে ও দেশের অভ্যন্তরে উল্লেখযোগ্য বৃষ্টিপাত হয়নি।
আরও পড়ুন
সূত্র আরও জানিয়েছে, রংপুর বিভাগের তিস্তা নদীর পানি সমতল হ্রাস পাচ্ছে, দুধকুমার নদীর পানি সমতল স্থিতিশীল আছে, অপরদিকে ধরলা নদীর পানি সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে। তিস্তা নদীর পানি সমতল রংপুর জেলার কাউনিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে, অপরদিকে ধরলা ও দুধকুমার নদীসমূহের পানি সমতল বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
এদিকে তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় রংপুরের তিন উপজেলায় অর্ধশতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়ে অন্তত ৩০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিস্তা নদীবেষ্টিত গংগাচড়া উপজেলার লক্ষ্মীটারী, কোলকোন্দ, গজঘণ্টা, আলমবিদির, নোহালী, কাউনিয়া উপজেলার বালাপাড়া, মধুপুর, হারাগাছ, ঢুসমারা, শহীদবাগের গান্নার চর, পীরগাছা উপজেলার ছাওলা ও পাওটানার প্রায় ৫০টি গ্রামের ৩০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এসব এলাকার বিভিন্ন জায়গায় গ্রামীণ রাস্তাঘাট তলিয়ে গেছে। বন্যার আতঙ্কে নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলের মানুষের নির্ঘুম রাত কেটেছে। এমন আকস্মিক বন্যায় চরম দুর্ভোগে পড়ছে বানভাসিরা। এই নিয়ে অষ্টমবারের মতো বন্যার কবলে পড়ল তিস্তাপাড়ের মানুষ।
তিস্তা নদীর কাউনিয়া পয়েন্টে রোববার সকাল থেকেই বিপৎসীমার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এ উপজেলায় টানা বৃষ্টি আর উজানের ঢলে ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে তিস্তা। পানি বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে উঠতি আমন ধান ও বিভিন্ন সবজি ক্ষেত ডুবে আছে বন্যার পানিতে। দীর্ঘ সময় ডুবে থাকলে এসব ফসলের মারাত্মক ক্ষতির শঙ্কা করছেন চাষিরা। একই সঙ্গে বন্যার পানিতে ভেসে গেছে বেশ কিছু পুকুরে মাছ। উপজেলার বালাপাড়া ও টেপামধুপুর ইউনিয়নের হরিচরণ শর্মা, আজমখাঁ, হয়রত খাঁ, বিশ্বনাথের চর, চরগনাই, ঢুষমারা, চর রাজিব, গোপিঙ্গা, গদাই, পাঞ্জরভাঙ্গা, তালুক শাহবাজপুরসহ চরাঞ্চলে অস্থায়ীভাবে পানিবন্দি হয়েছে কিছু পরিবার।
গদাই গ্রামের আবুল হোসেন ও আলামিন জানান, নদীর পানি বৃদ্ধির ফলে আমরা ভাঙন আতঙ্কে আছি, পানি কমতে শুরু করলেই ভাঙন শুরু হবে। ইতোমধ্যে অনেক বাড়িঘর ও ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
পাঞ্জরভাঙ্গা গ্রামের বাসিন্দা সহিদুল ইসলাম বলেন, দুই সপ্তাহ ধরে তিস্তা নদীর পানি কখনো বাড়ছে আবার কখনো কমছে। এখন তো পানি কমলেও বিপদ, বাড়লেও বিপদ। ভাঙন দেখা দিয়েছে। ঘরবাড়ি নিয়ে অনেক বিপদে আছি। এখন পানির কারণে কোথাও যেতে পারছি না। এই বন্যায় ঘরবাড়ি রক্ষা পাবে কি না আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। প্রতিবছর এভাবে আমরা বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি, কোনো সরকারই আমাদের দিকে মুখ তুলে দেখল না। একটা মহা-পরিকল্পনার কথা কতদিন ধরে শুনে আসছি, কিন্তু আজ পর্যন্ত কাজ শুরু হলো না।
উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের মধ্যে ৪টি ইউনিয়নের চরাঞ্চল ইতোমধ্যে তিস্তার পানি প্রবেশ করে বন্যা দেখা দিয়েছে। টেপামধুপুর ইউনিয়নের চরগনাই গ্রামে ১০টি বাড়ি তিস্তা নদীতে বিলীন হয়েছে। হারাগাছ, শহীদবাগ, বালাপাড়া ও টেপামধুপুর ইউনিয়নের প্রায় ২৫০ হেক্টর ফসলি জমি তলিয়েছে। শতাধিক পুকুর ও মৎস্য খামারের মাছ ভেসে গেছে।
বালাপাড়া ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান আনসার আলী বলেন, রাতের মধ্যে পানি বেড়েছে। নদী তীরবর্তী ও চরাঞ্চলের মানুষদের মধ্যে দুর্ভোগ ও ভাঙনের আতঙ্ক রয়েছে। কোথাও কোথাও ধান, বাদাম, শাক-সবজিসহ উঠতি বিভিন্ন ফসল পানিতে ডুবে যাওয়ায় বিপাকে পরেছে মানুষ। এরপরও নদীপাড়ের মানুষজনকে সাবধানে থাকতে বলা হয়েছে। আমরা খোঁজখবর নিচ্ছি, কোথাও কোথাও বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয় কি না।
টেপামধুপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান রাশেদুল ইসলাম জানান, চরগনাই গ্রামে নজরুল, সালাম, জলিল, সুজন, আজগর, সাঈদ, কাফি, আনিসুর, সুলতান, ও দুলু মিয়ার বাড়ি নদী গর্ভে বিলিন হয়ে গেছে। আরও ১১টি পরিবার ভাঙন ঝুঁকিতে রয়েছে, যে কোনো সময় সেগুলোও নদীতে তলিয়ে যেতে পারে। এছাড়াও উঠতি ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
এদিকে রোববার দুপুরে ভাঙনকবলিত এলাকায় কাউনিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. মহিদুল হক, জেলা ত্রাণ কর্মকর্তা মোতাহার হোসেন, প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. আহসান হাবীব সরকারসহ স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানরা পরিদর্শন করেছেন।
এ সময় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মহিদুল হক বলেন, তিস্তা নদী এলাকায় বন্যা ও ভাঙনের বিষয়ে আমরা সার্বক্ষণিক খোঁজ খবর রাখছি। কোথাও কোনো সমস্যা হলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইতোমধ্যে ভাঙনকবলিত ১০টি পারিবারকে শুকনা খাবার বিতরণ করা হয়েছে। ত্রাণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রয়েছে। উপজেলা প্রশাসন ও ত্রাণ বিভাগ বন্যা মোকাবিলায় প্রস্তুত রয়েছে।
পীরগাছা উপজেলার ছাওলা ইউনিয়নে তিস্তার জেগে ওঠা চরে বীজ বাদাম চাষ করে দিন বদলের চেষ্টা করছিলেন চরাঞ্চলের অভাবী পরিবারগুলো। কিন্তু আকস্মিক বন্যায় নদীর তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে তলিয়ে গেছে বীজ বাদামসহ মরিচ ও আমন ক্ষেত। এতে ব্যাপক ক্ষতির শঙ্কা করেছেন কৃষকরা।
স্থানীয় কৃষক ও উপজেলা কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, কয়েক বছর আগেও পীরগাছা উপজেলার চরাঞ্চলে বীজ বাদাম চাষ হতো মাত্র ৫০ হেক্টর জমিতে। এখন চাষের এলাকা তিনগুণ ছাড়িয়ে গেছে। চরাঞ্চলে বীজ বাদামের ফলন ভালো হয়। তাই কৃষকরা বীজ বাদাম চাষে ঝুঁকে পড়েছে। এ অঞ্চলে সাধারণত ঢাকা-১, বিনা-৬, বিনা-৭, বারি চিনা বাদাম-৬, বারি-৭ ও বারি-৮ জাতের বাদাম চাষাবাদ হয়। তবে বারি-৮ জাতের বাদাম বীজে সবচেয়ে বেশি ফলন হয়। এ জাতের বাদাম কৃষকের কাছে হাইব্রিড বাদাম হিসেবে পরিচিত। জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে বাদাম রোপণের সময় আগাম বীজ বাদামের চাহিদা বেড়ে যায়। এ সময় বীজ বাদামের দাম ভাল পাওয়া যায়। কিন্তু এবার আকস্মিক বন্যার কারণে চরাঞ্চলের ফসলি জমি নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে। এতে পানির নিচে থাকায় শতাধিক হেক্টর জমির বীজ বাদামের ব্যাপক ক্ষতির শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
কৃষকরা জানান, আমন ধানের তুলনায় বাদাম চাষ লাভজনক। তাই অনেকে আমনধানের পরিবর্তে বীজ বাদাম চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।
ছাওলা ইউনিয়নের চর গাবুড়ার কৃষক আকবর হোসেন বলেন, ধানের চেয়ে বীজ বাদামের দাম বেশি। গত বছর বীজ বাদাম চাষ করে ভাল লাভ পেয়েছিলাম। তাই এবারও চাষ করেছি। কিন্তু বন্যার কারণে ডুবে যাওয়ার সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেল। একই ইউনিয়নের জুয়ানের চরের কৃষক আব্দুর রহমান বলেন, বাইরে থেকে বীজ বাদাম কিনে রোপণ করা হয়। তাই এ বছর ২০ শতাংশ জমিতে বীজ বাদামের চাষ করেছি। মনে করেছিলাম বাদাম রোপণের সময় আর বাইরে থেকে বীজ বাদাম কিনতে হবে না। কিন্তু বানের কারণে সেটা মনে হয় সম্ভব হবে না।
পীরগাছা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বলেন, বন্যার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় চরাঞ্চলে বীজ বাদামসহ মরিচ, আমন ধান তলিয়ে গেছে। তবে দ্রুত পানি নেমে গেলে ক্ষতি কম হবে।
অন্যদিকে গংগাচড়া উপজেলার ইউপি সদস্য মনোয়ারুল ইসলাম বলেন, গত কয়েকদিন থেকে যে বন্যা ও পানির আশঙ্কা করা হয়েছিল তাই হয়েছে। এ বিষয়ে প্রশাসনের খুব বেশি তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়নি। হয়ত এখন আসবে, খোঁজখবর নেবে। আমরা জনপ্রতিনিধি হিসেবে কী করতে পারি, প্রশাসন বরাদ্দ দিলে তখন আমরা বানভাসি মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারি।
পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, দুপুরের দিকে পানি সামান্য কমলেও সন্ধ্যা থেকে তিস্তার পানি আবারও বাড়ছে। তাই চরাঞ্চলবাসীকে সর্তক থাকতে বলা হয়েছে। বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে নিয়ে ইতোমধ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সবার ছুটি বাতিল করা হয়েছে। সবাই এখন যে যার স্থানে দায়িত্ব, সেই স্থানে দায়িত্ব পালন করছেন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা।
তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি নজরুল ইসলাম হক্কানি বলেন, অসময়ের বন্যা ও ভাঙনে প্রতি বছর এক লাখ কোটি টাকার সম্পদ তিস্তার গর্ভে চলে যায়। এই সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য তিস্তা খনন, সংরক্ষণ ও তিস্তা মহা-পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা ছাড়া বিকল্প নেই।
পানি উন্নয়ন বোর্ড রংপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম জানান, তিস্তার কাউনিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার উপর দিয়ে পানি প্রবাহ হচ্ছে। যা রাতে আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাছাড়া পানি বাড়ায় তিস্তা সংলগ্ন নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। বিষয়গুলো নিয়ে সবসময় মনিটরিং করা হচ্ছে। যাতে রাস্তা ঘাট, ব্রিজ ভেঙে না যায় সেই বিষয়গুলো মাথায় রেখে কাজ করা হচ্ছে।
লালমনিরহাটে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি
লালমনিরহাটে আকস্মিক এ বন্যায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছে প্রায় ২৫ হাজার পরিবার। তিস্তার ডালিয়া পয়েন্টে পানির প্রবাহ বিপৎসীমার কাছাকাছি থাকায় আতংকিত হয়ে পড়ছে এখানকার মানুষেরা। নদী তীরবর্তী এলাকার বেশ কিছু রাস্তাঘাট ব্রিজ কালভার্ট পানির তোড়ে ভেঙে গেছে। আমন ধান ও বিভিন্ন সবজি ক্ষেত ডুবে আছে পানিতে। দীর্ঘ সময় ডুবে থাকলে এসব ফসলের মারাত্মক ক্ষতির শঙ্কা করছেন চাষিরা। একই সাথে বন্যার পানির তোড়ে ভেসে গেছে বেশ কিছু পুকুরের মাছ।
সলেডি স্প্যার বাঁধ-২ এলাকার সাগর মিয়া বলেন, শনিবার রাতে পানির গর্জনে ঘুমাতে পারিনি। সলেডি স্প্যার বাঁধে ব্রিজ অংশের উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়েছে। এ সময় বাঁধ কাঁপছিল। আমরা ভয় পেয়েছিলাম যে, স্প্যার বাঁধ বুঝি ভেসে যায়। স্থানীয়রা রাত জেগে বাঁধে বস্তা ফেলে রক্ষা করেছে। বন্যার সময় নির্ঘুম রাত কাটে তিস্তাপাড়ের মানুষদের। একই গ্রামের আব্দুর রশিদ ছোট বলেন, গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে হাঁটু পানি। বাচ্চা বৃদ্ধদের নিয়ে নিদারুণ কষ্টে পড়েছি। শুকনো খাবার প্রয়োজন হলেও এখন পর্যন্ত আসেনি। এবারের বন্যায় তেমন কেউ খবর নিতেও আসেনি।
হাতীবান্ধা উপজেলার পশ্চিম বিছনদই গ্রামের তমিজ উদ্দিন বলেন, আমাদের গ্রামে আড়াই/তিন শত পরিবারের বসবাস। সবাই শুক্রবার রাত থেকে পানিবন্দি। দিন যত যাচ্ছে পানিবন্দির সংখ্যা তত বাড়ছে। বন্যার সময় শিশু বৃদ্ধ আর গবাদি পশুপাখি নিয়ে বড় বিপদে পড়তে হয়। বন্যা হলেই নির্ঘুম রাত কাটাতে হয় তিস্তাপাড়ের মানুষদের। আমরা ত্রাণ নয়, চাই তিস্তার মহা-পরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়ন।
ডাউয়াবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মশিউর রহমান বলেন, আমার ইউনিয়নে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বিষয়টি উপজেলা ও জেলা প্রশাসনকে অবগত করা হয়েছে। মহিষখোচা ইউনিয়নের প্যানেল চেয়ারম্যান আব্দুল মজিদ হোসত বলেন, ৩ হাজারের অধিক পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বাঁধগুলো রক্ষায় সাধারণ মানুষদের নিয়ে বস্তা ফেলে রক্ষার চেষ্টা করা হচ্ছে।
বন্যা পানি তলিয়ে গেছে লালমনিরহাট সান্তাহার রেলরুটের অর্ধকিলোমিটার পথ। ফলে দিনভর ঝুঁকি নিয়েও ধীর গতিতে ট্রেন চলাচল করেছে। একইসঙ্গে জরুরিভিত্তিতে সংস্কার করা হয় রেললাইন। আপাতত রেল যোগাযোগ স্বাভাবিক রয়েছে।
লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শুনিল কুমার বলেন, রোববার সকাল ৬টায় তিস্তা নদী ডালিয়া পয়েন্টে পানিপ্রবাহ বেড়ে বিপৎসীমার ২ সেন্টিমিটার ওপর প্রবাহিত হয়। দুপুরে তা কমে গিয়ে বিপৎসীমার নিচে নেমে আসে। আশা করছি দ্রুতই বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে।
লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক এইচ এম রকিব হায়দার বলেন, বন্যাকবলিতদের জন্য ১৩ লাখ টাকা ও ৯০ মেট্রিকটন জিআর চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। আজকে স্বল্প পরিসরে বিতরণ শুরু করেছি। সোমবার সকলের কাছে পৌঁছে যাবে ত্রাণ। বন্যা বাড়লে তা মোকাবিলা করতে জেলা উপজেলা প্রশাসন আমরা প্রস্তুত রয়েছি।
কুড়িগ্রামে বাড়ছে ভাঙন আতঙ্ক
কুড়িগ্রামে ধরলা, দুধকুমার ও ব্রহ্মপুত্রসহ অন্যান্য নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। প্লাবিত হয়েছে তিস্তার তীরবর্তী রাজারহাট উপজেলার ঘড়িয়ালডাঙ্গা, বিদ্যানন্দ, উলিপুর উপজেলার দলদলিয়া, বজরা, থেতরাই, গুনাইগাছ এবং চিলমারী উপজেলার রমনা মডেল ইউনিয়নের আংশিক অংশ। এসব ইউনিয়নের চর ও নিম্নাঞ্চলের প্রায় ৪ শতাধিক পরিবার, গ্রামীণ কাঁচা সড়কসহ ১৫৯ হেক্টর জমির রোপা আমন এবং মৌসুমি ফসলের ক্ষেত নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে।
রাজারহাট উপজেলার খিতাব খাঁ গ্রামের কৃষক আব্দুল কাদের বলেন, আমার তিন বিঘা জমিতে আধা পাকা ধান ক্ষেতে হঠাৎ তলিয়ে গেছে। কিছু ধান কাটতে পারলেও অবশিষ্ট সব পানির নিচে তলিয়ে গেছে। আমার খুব ক্ষতি হয়ে গেল।
আরেক কৃষক নুর ইসলাম বলেন, আমা শাঁক সবজি ও বাদাম ক্ষেত পানির নিচে তলিয়ে গেছে। হঠাৎ করে এমন পানি হবে চিন্তাও করতে পারিনি।
উপজেলা কৃষি অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) হৈমন্তি রানী বলেন, শনিবারের তথ্য মতে চরাঞ্চলে ৪০ হেক্টর জমির ধান, বাদাম, মরিচ ক্ষেত তলিয়ে গেছে। যেভাবে পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে আরও কয়েক শত হেক্টর ফসলের ক্ষেত তলিয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড বিভাগ জানায়, ধরলা, দুধকুমার ও ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বিভিন্ন পয়েন্টে বৃদ্ধি পেলেও তা বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি কমার সম্ভাবনা রয়েছে।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান বলেন, খিতাব খাঁ মাঝের চরের প্রায় ৫ শতাধিক পরিবার পানিবন্দি হয়েছে। পানিবন্দী পরিবারদের জন্য ১ কেজি মুড়ি, আধা কেজি চিড়া, খাবার স্যালাইন, মোমবাতি, দিয়াশলাই ও পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বিতরণ করেছে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা খাদিজা বেগম।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার খাদিজা বেগম বলেন, এ উপজেলায় বন্যা হতে পারে তাই আগাম প্রস্তুতি গ্রহণ করে চরাঞ্চলের মানুষজনকে নিরাপদ স্থানে ও আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়ার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। এছাড়া পানিবন্দিদের মাঝে শুকনা খাবার বিতরণ করা হচ্ছে।
গাইবান্ধার নদ-নদীতে বিপৎসীমার নিচে পানি
গাইবান্ধার প্রধান চার নদ-নদীতে পানি বাড়তে শুরু করেছে। এতে জেলার ১৬৫টি চরের নিম্নাঞ্চলে পানি উঠতে শুরু করেছে। তিস্তার পানি কাউনিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও গাইবান্ধার প্রধান তিন নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার অনেক নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আপাতত জেলায় বন্যার আশঙ্কা নেই বলে জানিয়েছে পাউবো।
গাইবান্ধা পাউবোর নিয়ন্ত্রণ কক্ষের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত কয়েক দিন থেকে ধীর গতিতে প্রধান চার নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। ব্রহ্মপুত্র নদের পানি ফুলছড়ি উপজেলার তিস্তামুখঘাট পয়েন্টে ৭৪ সেন্টিমিটার, ঘাঘট নদীর পানি জেলা শহরের নতুন ব্রিজ পয়েন্টে ৫৭ সেন্টিমিটার ও করতোয়ার পানি গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার চকরহিমাপুর পয়েন্টে ৭৩ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে।
এদিকে জেলার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে তিস্তা নদী। হঠাৎ পানি বাড়ায় তারাপুর, হরিপুর, শ্রীপুর, কাপাসিয়া, বেলকা, গাইবান্ধা সদর উপজেলার মোল্লারচর, কামারজানি, সাঘাটার হলদিয়া ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলে ফের পানি ঢুকে পড়ার শঙ্কায় রয়েছে। ইতিমধ্যে নিম্নাঞ্চলের চরগুলোতে পানি প্রবেশ করেছে। এতে স্থানীয়দের মাঝে নতুন করে বন্যা আতঙ্ক বিরাজ করছে। চরের নিম্নাঞ্চলে আবারও পানিবন্দি হওয়ার শঙ্কা করছে সাধারণ মানুষ।
কাপাসিয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. মঞ্জু মিয়া বলেন, নদীতে পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রবল স্রোত দেখা দিয়েছে। আমার ইউনিয়নের ৩ ও ৪ নং ওয়ার্ডের অবস্থা খুবই খারাপ। ফসিল জমিসহ ভাঙ্গছে ঘরবাড়ি। এ পর্যন্ত ৩টি বসতবাড়ি নদীতে গেছে।
হরিপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মোজাহারুল ইসলাম বলেন, আমার ইউনিয়নের পাড়া সাদুয়া ও লখিয়ার পাড়া গ্রামের ভাঙন দেখা দিয়েছে। এ পর্যন্ত ২টি বাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। পানির তীব্র স্রোতে ফসিল জমিও ভাঙতে শুরু হয়েছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে ভয়াবহ রূপ নিবে তিস্তা নদী।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) ওয়ালিফ মন্ডল বলেন, তিস্তা নদীতে পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ বিষয়ে আমরা ব্যাপক তৎপর আছি। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার জনপ্রতিনিধিদের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছি এবং আমরা নিজেরাও যাচ্ছি।
গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) উপ সহকারী প্রকৌশলী রায়হানুল ইসলাম বলেন, উজান থেকে পানি আসছে এবং গত কয়েকদিনের বৃষ্টির পানিতে জেলার সব নদ-নদীর পানি বাড়তে শুরু করেছে। চরের কিছু নিচু অঞ্চলে পানি প্রবেশ করেছে। তিস্তার পানি বৃদ্ধি পেলেও করতোয়া, ঘাঘট ও ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। আপাতত এ পানিতে বন্যার আশঙ্কা নেই। আমরা সার্বক্ষণিক নজর রাখছি।
গাইবান্ধা জেলা প্রশাসক চৌধুরী মোয়াজ্জম আহমদ বলেন, সুন্দরগঞ্জ উপজেলার দুই একটি পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। করতোয়া, ঘাঘট, ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বিপদসীমার অনেক নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে সবধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
যা বলছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র
আবহাওয়া সংস্থাসমূহের তথ্যানুযায়ী, রংপুর বিভাগ ও তৎসংলগ্ন উজানে অতি ভারী বৃষ্টিপাতের (≥৮৯ মি.মি/২৪ ঘণ্টা) প্রবণতা কমে এসেছে। আগামী ৩ দিন পর্যন্ত তিস্তা নদীর পানি সমতল হ্রাস পেতে পারে। অপরদিকে ধরলা ও দুধকুমার নদীসমূহের পানি সমতল আগামী ১৮ ঘণ্টায় স্থিতিশীল থাকতে পারে এবং পরবর্তী ২ দিন হ্রাস পেতে পারে। আগামী ১২ ঘণ্টায় লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা জেলার তিস্তা নদী সংলগ্ন চরাঞ্চল এবং কতিপয় নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল থেকে পরবর্তীতে উন্নতি হতে পারে। পরবর্তী ২ দিনে তিস্তা নদীর পানি সমতল হ্রাস পেয়ে বিপৎসীমার নিচে প্রবাহিত হতে পারে। অপরদিকে আগামী ৩ দিন পর্যন্ত কুড়িগ্রাম জেলার ধরলা ও দুধকুমার নদীসমূহের পানি সমতল বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে।
রংপুর বিভাগের অন্যান্য প্রধান নদীসমূহ— আপার আত্রাই, পূনর্ভবা, ঘাঘট, ইছামতি-যমুনা ও যমুনেশ্বরী নদী সমূহের পানি সমতল স্থিতিশীল আছে, অপরদিকে আপার করতোয়া ও টাঙ্গন নদীসমূহের পানি সমতল হ্রাস পাচ্ছে এবং বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আগামী ৩ দিন পর্যন্ত রংপুর বিভাগের এই সকল নদীসমূহের পানি সমতল হ্রাস পেতে পারে।
রংপুর বিভাগের ব্রহ্মপুত্র নদ ও তার ভাটিতে যমুনা নদীর পানি সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আগামী ২ দিন ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদ-নদীর পানি সমতল বৃদ্ধি পেতে পারে এবং পরবর্তী ৩ দিন স্থিতিশীল থাকতে পারে, তবে বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে।
ডালিয়া পাউবোর উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মোহাম্মদ রাশেদীন বলেন, উজানের ঢল আর বর্ষণে তিস্তায় পানির প্রবাহ বেড়েছে। রোববার সকালে তিস্তার ডালিয়া ও কাউনিয়া পয়েন্টে পানি প্রবাহ বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও এখন ডালিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সবগুলো জলকপাট খুলে পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে।
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এসকেডি