ধানুয়া কামালপুর স্থলবন্দর চালু থাকলেও তিন মাস ধরে আমদানি বন্ধ
ভারতের মেঘালয় রাজ্য ঘেঁষা জামালপুরের একমাত্র স্থলবন্দর বকশীগঞ্জ উপজেলার ধানুয়া কামালপুর স্থলবন্দর দিয়ে তিন মাস ধরে আমদানি বন্ধ রয়েছে। এতে প্রায় ১৫ হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। আমদানি বন্ধ থাকায় রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার। বন্দর কর্তৃপক্ষের মতে গত তিন মাসে প্রায় দেড় কোটি টাকার রাজস্ব থেকে সরকার বঞ্চিত হয়েছে।
স্থলবন্দর ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বন্দরে বেশি চার্জ, অতিরিক্ত শুল্ক আদায়, ভারতের পাথরের মূল্য বেশি হওয়া, ব্যবসায়ীদের সুবিধামতো পাথর আমদানির সুযোগ না দেওয়াসহ নানা সমস্যার কারণে তিন মাস ধরে আমদানি বন্ধ রেখেছেন ব্যবসায়ীরা। চলতি অর্থবছরে এই বন্দরের শুল্ক বিভাগ থেকে বছরে ১০ কোটি টাকার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু এই বন্দর থেকে চলতি অর্থ বছরে এখন পর্যন্ত কোনো আমদানি না হওয়ায় এক টাকারও রাজস্ব আদায় করা সম্ভব হয়নি । চলতি বছরের জুন মাস থেকে আমদানি বন্ধ রয়েছে ধানুয়া কামালপুর স্থলবন্দরে। পাথর আমদানি বন্ধ থাকায় খাঁ খাঁ করছে পুরো বন্দর। বন্দরে পড়ে রয়েছে শতশত পাথর ভাঙার ক্রাশার মেশিন। কর্মচাঞ্চল্য নেই বন্দর এলাকায়। এতে প্রায় পনেরো হাজারের মতো শ্রমিক বেকার হয়ে মানবেতর জীবন পার করছেন।
১৯৭৪ সালে জেলার বকশীগঞ্জ উপজেলার ধানুয়া কামালপুর সীমান্তে লোকাল কাস্টমস (এলসি) স্টেশনটি চালু হয়। ধানুয়া কামালপুর এলসি স্টেশনটি ২০১৫ সালের মে মাসের দিকে পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দরে রূপ নেয়। পাথর, আদা, সুপারিসহ প্রায় ৩৪টি পণ্য আমদানি করার অনুমতি রয়েছে এই বন্দর দিয়ে। তবে এই বন্দর দিয়ে বেশিরভাগ সময় মেঘালয় রাজ্য থেকে পাথর আমদানি হয়ে থাকে। প্রতিদিন প্রায় কয়েকশ ট্রাক পাথর নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করতো এই বন্দর দিয়ে।
লোড-আনলোড শ্রমিক হাবিবুর রহমান বলেন, বন্দরে লোড-আনলোডের কাজ করে প্রতিদিন এক হাজার টাকা আয় করতাম। বন্দর বন্ধ হওয়ার কারণে কাজ নাই, এখন এক টাকাও ইনকাম হয় না। বেকার হয়ে আছি, ধারকর্জ করে চলতেছি। এখন ধারকর্জও কেউ দেয় না, বউ-পোলাপান নিয়ে খুব কষ্টে আছি।
ফরিদ মিয়া নামে আরেক শ্রমিক বলেন, ছয় বছর থেকে আমি পাথর ভাঙার কাজ করি। এখন পাথর ভাঙা নাই, বিভিন্ন জায়াগায় গিয়ে মানুষের বাড়িতে কাজ করি। বউ-বাচ্চা নিয়ে কীভাবে চলবো, এই নিয়ে চিন্তায় আছি। আমদানি চালু হলে পাথর ভাঙার কাজ করে স্বাভাবিক কর্মজীবনে ফিরতে পারবেন বলে জানান তিনি।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, পার্শ্ববর্তী কুড়িগ্রামের রৌমারী বন্দরে ওয়ে ব্রিজ না থাকায় স্কেল দিয়ে পাথর পরিমাপ করা হয়। ফলে ব্যবসায়ীরা সেখান থেকে পাথর আমদানি করে বেশি লাভবান হচ্ছে। এখানে ওয়ে ব্রিজের মাধ্যমে পাথর পরিমাপ করে অতিরিক্ত শুল্ক আদায় করার কারণে ব্যবসায়ীরা পাথর আমদানি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। ফলে সম্ভাবনাময় এই বন্দরে আমদানি-রপ্তানিতে ভাটা পড়েছে।
জাবেদ ট্রেডার্সের মালিক আমদানিকারক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ইন্ডিয়া থেকে মাল দিতে পারে ১২ টন, আমাদের কাস্টম বলতেছে মিনিমাম ২৫ টন মাল আনতে হবে। ইন্ডিয়ার রাস্তা ভালো না থাকার কারণে ১২ টনের বেশি মাল আনার অনুমতি নেই। আমাদের মাল আসে ১০-১৭ টন, তারা আমাদের ওপর বাড়তি চাপ দিতেছে ২৫ টনের ট্যাক্স দিতে হবে। আমরা ২৫ টনের ট্যাক্স কেন দেব। আমাদের দাবি হলো, এখানে স্কেল আছে ওজন দেওয়ার পর যে পরিমাণ ট্যাক্স আসবে সেই পরিমাণ পরিশোধ করবো, আমরা কোনো ট্যাক্স ফাঁকি দিতে চাই না।
আমদানিকারক ও সিএন্ডএফ এজেন্ট রুবেল মাহমুদ বলেন, বন্দর হওয়ার পর থেকে আমদানি করা পাথর স্কেল করা হয়। এখানে তারা লোড-আনলোডের টাকা নিচ্ছে। নিয়ম অনুযায়ী এই টাকা ঠিকাদারের দেওয়ার কথা কিন্তু আমাদের নিকট থেকে নেওয়া হচ্ছে। আবার ডিপোতে নিয়ে লোড-আনলোড করতে আমাদের ডাবল টাকা দিতে হচ্ছে। ভারত থেকে যে পাথর আসে সেটি মাইনিং করা পাথর। পাথরগুলো মেশিনের সাহায্যে লোড করা হয়। একটা গাড়িতে কমপক্ষে প্রায় ত্রিশ শতাংশ মাটি আসে, সেই মাটির দাম দিতে হয়। এই সমস্যাগুলোর জন্য আমদানি বন্ধ রয়েছে। আমাদের মেশিন বন্ধ, জমির ভাড়া দিতে হচ্ছে, ব্যাংক লোনের সুদ দিতে হচ্ছে। মেঘালয় রাজ্যের এলসি স্টেশনের সঙ্গে আমাদের এলসি স্টেশনের মধ্যে সামঞ্জস্য করা হলে ব্যবসা করা সম্ভব বলে জানান তিনি।
ব্যবসায়ী সভাপতি গোলাম রসুল সেতু বলেন, ইন্ডিয়া থেকে ১২ টনের অতিরিক্ত মাল বহন করা যাচ্ছে না, আর বাংলাদেশে ২৫ টনের নিচে বন্দর কর্তৃপক্ষ মাল মেনে নিচ্ছে না। যার কারণে অন্য বন্দরের চাইতে আমাদের মালের কস্টিং বেড়ে যাচ্ছে। ভারত থেকে জেসিবি দিয়ে মাল লোড করার কারণে মালের সঙ্গে ওয়েস্টেজ/মাটি আসে যেটা আমাদের কস্টিং করে নিতে হচ্ছে। এই কস্টিং লেস করা প্রয়োজন, তাহলে এই পোর্টের সঙ্গে অন্য পোর্টের পাথরের দাম এক থাকবে, তখন আমরা ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারবো। পাথর বিক্রি না হওয়ার কারণে অনেক শ্রমিক বেকার হয়ে আছে, ব্যবসায়ীদের ব্যাংক লোনের সুদ বেড়ে যাচ্ছে, এই পরিস্থিতিতে কর্তৃপক্ষের নিকট দ্রুত ব্যবসার পরিবেশ তৈরির দাবি জানান তিনি।
ধানুয়া কামালপুর স্থলবন্দরের ইনচার্জ হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মো. আব্দুল হান্নান বলেন, ধানুয়া কামালপুর স্থলবন্দরের পক্ষ থেকে সকল কার্যক্রম সচল আছে, আমাদের অফিস খোলা এবং আমরা এক্সপোর্টার ও ইমপোর্টারদের সব সময় সহযোগিতা করার জন্য বসে আছি। এখন কেউ মালপত্র আনছে না, এটা এক্সপোর্টার ও ইমপোর্টার এবং কাস্টমসের বিষয়। আমাদের বন্দরের পক্ষ থেকে কোনো বাধা নেই।
ধানুয়া কামালপুর স্থলবন্দরের শুল্ক বিভাগের রাজস্ব কর্মকর্তা সঞ্জয় কুমার দাস বলেন, এখানে গত বছরের নভেম্বর মাসে বন্দর চালু হয়েছে। বন্দর চালু হওয়ার কারণে ইমপোর্টারদের খরচ কিছুটা বেড়েছে, লোডিং-আললোডিং চার্জ, লেবার চার্জ, স্কেল চার্জ দিতে হয়। আমাদের পার্শ্ববর্তী একটি রৌমারী স্টেশন রয়েছে, সেখানে বন্দর নাই, ইমপোর্টারদের এই চার্জগুলো দিতে হয় না। তাই রৌমারী স্টেশনের ইমপোর্টারদের সঙ্গে আমাদের ইমপোর্টারদের প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এই কারণেই হয়তো আমাদের ইমপোর্ট কমে গেছে। আমরা চাইবো, ইমপোর্টার, স্টেকহোল্ডার, সিএন্ডএফ এজেন্টদের সঙ্গে আলোচনা করে কীভাবে ইমপোর্ট সচল করা যায় সে বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করবো।
মুত্তাছিম বিল্লাহ্/এএমকে