প্রধান অফিস সহকারীর বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির যত অভিযোগ
মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলা স্বাস্থ্যকমপ্লেক্সের ভারপ্রাপ্ত প্রধান সহকারী আশরাফুজ্জামান ফরিদের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগের শেষ নেই। গত ২০ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার তোপের মুখে তিনি অভিযোগ স্বীকার করে অব্যাহতি দিয়ে কর্মস্থল ত্যাগ করেন।
আশরাফুজ্জান ফরিদের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ খতিয়ে দেখতে ইতোমধ্যেই তদন্ত শুরু করেছে জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ। গত বৃহস্পতিবার (১৯ সেপ্টেম্বর) তিন সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করেন।
জানা যায়, অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে গত ২০ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা স্বাস্থ্যকমপ্লেক্স চত্বরে আন্দোলন করেন। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের তোপের মুখে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. ফজলে বারী, সিনিয়র স্টাফ নার্স রুনা আক্তার ও ভারপ্রাপ্ত প্রধান সহকারী আশরাফুজ্জান ফরিদের দুর্নীতি ও অনিয়মের কথা স্বীকার করে অব্যাহতি দিয়ে কর্মস্থল ত্যাগ করেন। পরে তাদের অব্যাহাতিপত্রটি জেলা সিভিল সার্জন ডা. মো. মকছেদুল মোমিন গ্রহণ করেন এবং কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকার আদেশ দেন।
তবে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা কর্মস্থল থেকে চলে গেলেও স্বপদে বহাল ও অব্যাহতিপত্রটি প্রত্যাহারের জন্য দুই দিন পরেই সিভিল সার্জন বরাবর আবেদন করেন ফরিদ। এরপর উপজেলা হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত প্রধান সহকারী আশরাফুজ্জামান ফরিদের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগের বিষয় তদন্ত করতে হরিরামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মেহেরুবা পান্নাকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে সিভিল সার্জন কার্যালয়। তদন্ত কমিটির বাকি সদস্যরা হলেন, সিভিল সার্জন কার্যালয়ের ডা. আল আমীন ও শিবালয় উপজেলা স্বাস্থ্যকমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. অমিত সাহা।
জানা গেছে, অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে ছয় বছর আগে শিবালয় উপজেলা স্বাস্থ্যকমপ্লেক্স থেকে দোহারে বদলি করা হয় ফরিদকে। এর কিছুদিন পরে তদবির করে তিনি মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্যকমপ্লেক্সে যোগদান করেন। এরপর সেখান থেকে শিবালয় উপজেলা স্বাস্থ্যকমপ্লেক্সে যোগদান করেন। তার পর থেকে প্রায় তিন বছর ধরে হাসপাতালের নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে লিপ্ত হয়ে পরেন এবং হাসপাতালের নিজের একক আধিপত্য বিস্তার করেন।
আশরাফুজ্জান ফরিদের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ
শিবালয় উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. ফজলে বারী যোগদানের পর থেকে অপকর্মের মাধ্যমে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পরেন। আর তার অনিয়ম ও দুর্নীতিতে সার্বিক সহযোগিতা করেন হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত প্রধান অফিস সহকারী আশরাফুজ্জামান ফরিদ। তাদের দুইজনের যোগসাজশে ২০২২-২৩ অর্থ বছরের এমএইচভিদের বেতন থেকে প্রায় ৩ লাখ টাকা, হাসপাতালের জিপ গাড়ির জ্বালানি বাবদ দুই বছরে লক্ষাধিক টাকা, হাসপাতাল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কাজ বাবদ গত দুই বছরে ২ লাখ টাকা, কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোর বিভিন্ন বরাদ্দে থেকে ৩ লাখ টাকা, এমএসআর টেন্ডার বাবদ ২০ লাখ টাকাসহ বিভিন্ন বরাদ্দ থেকে লাখ লাখ টাকা লোপাট। এ ছাড়া উপজেলার ২২টি কমিউনিটি ক্লিনিকের জন্য বাৎসরিক ১২ হাজার টাকা বরাদ্দে অনিয়ম। উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে বারীর যোগসাজশে স্থানীয় সাবেক এমপি সালাউদ্দিন মাহমুদ জাহিদের নাম ভাঙিয়ে এসব অনিময়-দুর্নীতি করেছেন ফরিদ। গত ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর হাসপাতালের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়গুলো জনসম্মুখে প্রকাশ পায়।
উলাইল ইউনিয়নের সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ফরিদের নামে হাসপাতাল চত্বরে কোনো কোয়ার্টার বরাদ্দ না থাকলেও প্রভাব খাটিয়ে ২য় শ্রেণির স্টাফ কোয়ার্টারে এসি লাগিয়ে বিলাসবহুল জীবনযাপন করে আসছেন। বদলির ভয় দেখিয়ে হাসপাতালের অনেক কর্মকর্তা ও কর্মচারীর কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা নিতেন তিনি। তার বিরুদ্ধে কেউ কোনো কথা বলতে পারতো না। অভিযোগ দিতে গেলেই বদলির ভয় দেখাতো।
যক্ষ্মা বিভাগের তাসলিমা খানম বলেন, হাসপাতালে তার অনিয়মের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলা যায় না। আমরা স্টাফরা অনেক অসহায়ভাবে কাজ করছি। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দিতে চাইলে তাদেরকে ফরিদের অনুসারীদের দিয়ে অশালীন ভাষায় গালাগালসহ নারী স্টাফদের কুরুচিপূর্ণ ভাষায় কথা বলতো।
বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীরা বলেন, তদন্ত কমিটির কাছে আমরা সাক্ষ্য জমা দিয়েছি। হাসপাতালের প্রধান অফিস সহকারী আশরাফুজ্জামান ফরিদের অনিয়ম ও দুর্নীতি ফাঁস হওয়ার পর থেকে তিনি দুর্নীতি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। গত ২০ আগস্ট নিজের অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়টি স্বীকার করে স্বেচ্ছায় অব্যাহতিপত্র সিভিল সার্জনের কাছে জমা দেন। এখন আবার স্বপদে বহালের চেষ্টাও করছেন। ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে তার বিরুদ্ধে আরও নতুন অভিযোগ তদন্ত কমিটির সদস্যদের নিকট তুলে ধরা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে আজকে বেলা ৩টার দিকে অভিযুক্ত আশরাফুজ্জামান ফরিদের ব্যক্তিগত মুঠোফোনে একাধিকবার কল দিলেও তিনি কলটি রিসিভ করেননি। ফলে তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
শনিবার বেলা সোয়া ২টার দিকে মুঠোফোনে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির প্রধান ও হরিরামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মেহেরুবা পান্না বলেন, আমরা গত বৃহস্পতিবার শিবালয় উপজেলা স্বাস্থ্যকপ্লেক্সের প্রধান অফিস সহকারী ফরিদের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করেছি। সেখানে ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে ১০ জন এবং হাসপাতালের আটজন স্টাফদের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যেই তদন্ত প্রতিবেদন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছ জমা দেওয়া হবে।
এ বিষয়ে সিভিল সার্জন ডা. মো. মকছেদুল মোমিন বলেন, অভিযুক্ত ফরিদের অব্যাহাতিপত্র পাওয়ার পর বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষতে জানানো হয়। তবে ফরিদ তার অব্যাহতিপত্রে আপত্তি দেওয়ার কারণে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আমি এখনও তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পাইনি। তবে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে যদি তিনি দোষী প্রমাণিত হন তাহলে অবশ্যই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
সোহেল হোসেন/এএমকে