‘র’ গুজবের বলি বিজিবির নায়েক আব্দুল আলীম, অজ্ঞাতদের নামে মামলা
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের দিন গাজীপুরের শ্রীপুরে রুদ্ধশ্বাস যাত্রায় প্রাণ হারান বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্য আব্দুল আলীম। ‘সড়কে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ আর সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিএসএফ নেমেছে’ এমন গুজব ছড়িয়ে পড়লে স্থানীয় জনতা উত্তেজিত হয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত তাদের হামলায় প্রাণ হারান বিজিবির সেই নায়েক। সেদিনের হামলায় গুরুতর আহত হন অন্তত ৬৪ জন বিজিবি সদস্য। পুড়িয়ে দেওয়া হয় তাদের সঙ্গে থাকা সব যানবাহনও।
সেই ঘটনায় এবার মামলা দায়ের করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার (১৯ সেপ্টেম্বর) বিজিবি ময়মনসিংহ সেক্টর সদর দপ্তরের জেসিও নায়েব সুবেদার সোহেল রানা বাদী হয়ে শ্রীপুর থানায় এ মামলা দায়ের করেন।
শনিবার (২১ সেপ্টেম্বর) সকালে মামলার তথ্য নিশ্চিত করেছেন শ্রীপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ জয়নাল আবেদীন মণ্ডল।
তিনি বলেন, তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
আরও পড়ুন
মামলায় বাদী অভিযোগ করেন, গত ৫ আগস্ট সকাল ৯টায় বিজিবি ময়মনসিংহ সেক্টর সদর দপ্তরের নির্দেশনায় গাজীপুর শিল্প এলাকার নিরাপত্তার জন্য ২টি পিকআপ ও ৮টি বেসামরিক বাসযোগে ময়মনসিংহ ব্যাটালিয়ন (৩৯ বিজিবি) থেকে বিজিবি সদস্যরা গাজীপুরে মোতায়েনের উদ্দেশে রওনা হন। প্রথম দফায় ত্রিশাল, ভালুকাসহ বেশ কয়েকটি স্থানে ব্যারিকেডের সম্মুখীন হন তারা। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বিজিবি সদস্যরা মাওনা ফ্লাইওভার (মাওনা চৌরাস্তা) সংলগ্ন এলাকায় পৌঁছালে বড় ব্যারিকেডের সম্মুখীন হন। তখন স্থানীয়দের মাঝে গুজব সৃষ্টি হয়, এই কনভয়ে ভারতের বিএসএফ এবং ‘র’ এর এজেন্ট বিজিবি’র পোশাক পরে ছদ্মবেশে ঢাকার উদ্দেশে যাচ্ছেন। তখন বেশ কয়েকজন ক্ষিপ্ত হয়ে বাসে ওঠে বিজিবি সদস্যদের বিএসএফ এবং ‘র’ এর এজেন্ট বলে গালিগালাজ করতে থাকেন।
বাসে উপস্থিত বিজিবি সদস্যরা তাদের পরিচয় নিশ্চিত করাসহ প্রত্যেকের আইডি কার্ড প্রদর্শন করেন। তাদের কথায় কর্ণপাত না করে তারা বাস দুটিকে একটি পেট্রল পাম্পের কাছে নিয়ে যেতে বাধ্য করেন। এ সময় বাসে থাকা বিজিবি সদস্যদের অস্ত্র এবং মোবাইল বিক্ষোভকারীরা বস্তায় করে নিয়ে যায়। তখন বাসের ভেতর অবস্থানকারী বিজিবি সদস্যদের পুড়িয়ে দেওয়ার জন্য বাসে পেট্রল ঢালতে থাকেন। এ সময় বাসে অবস্থানকারী বিজিবি সদস্যরা জীবন বাঁচাতে বস্তা থেকে অস্ত্র নিয়ে বাসের বাইরে নেমে পড়েন। এ সময় উত্তেজিত লোকজন বিজিবির হাত থেকে অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়ে লাঠি দিয়ে মারতে থাকেন। বিক্ষুব্ধ জনতার মারধরে নায়েক মো. আব্দুল আলীম শেখসহ ১০/১২ জন গুরুতর আহত হন।
সংবাদ পেয়ে সামনে পিকআপে থাকা দলটি তাদের উদ্ধারের জন্য এগিয়ে যায়। ততক্ষণে গুজব ছড়িয়ে পড়ার কারণে পিকআপে থাকা দলটি উত্তেজিত জনতার রোষানলে পড়ে। ফলে দলটি কাছাকাছি এসেও উদ্ধার করতে ব্যর্থ হয় এবং এক সময় দলটি পিকআপ ছেড়ে দৌড়ে গ্রামের ভেতর এক বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। তখন বিক্ষুব্ধ জনতা পিকআপটি আগুনে পুড়িয়ে দেয়।
বেলা ৩টার দিকে গাজীপুর ব্যাটালিয়ন (৬৩ বিজিবি) থেকে আরেকটি দল ২টি এপিসিসহ উদ্ধারের জন্য ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। পরে স্থানীয়রা তাদেরও আটকে দেয়। বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে ময়মনসিংহ থেকে আরও একটি দল বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও ২জন ম্যাজিস্ট্রেটসহ তাদের উদ্ধার করতে যায়। ইতোমধ্যে বিজিবি সদর দপ্তরের হেলিকপ্টারে কয়েকবার আটকে পড়া বিজিবি সদস্যদের উদ্ধারের চেষ্টা করা হয়।
এর মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ করার খবর ছড়িয়ে পড়লে আরও কয়েক হাজার মানুষ এ মিছিলে যোগ দেয়। ময়মনসিংহ থেকে আসা দলটিকে উত্তেজিত আক্রমণকারীরা ধাওয়া করে মারতে মারতে প্রায় ৬ কিলোমিটার পর্যন্ত দূরে নিয়ে গড়গড়িয়া মাস্টার বাড়ির একটি মসজিদে আটকে রাখে।
আরও পড়ুন
গুরুতর আহত ৫ জন মুসলমান এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার পর মসজিদে তাদের প্রবেশ করতে দেওয়া হয়। এ সময় হাজারো উত্তেজিত আক্রমণকারী মসজিদের কাঁচের দরজা ভেঙে ফেলার চেষ্টা করে। তখন কিছু স্থানীয়দের সহায়তায় দুজন বিজিবি সদস্য বেসামরিক পোশাক পরে বের হতে পারেন। এরপর আরও আক্রমণকারী একত্রিত হয়ে রামদা এবং লাঠিসহ মসজিদের মধ্যে অবস্থানকারী বাকি ৩ জনকে তাদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য চিৎকার করতে থাকেন।
স্থানীয় অনেকের সহায়তায় তিন বিজিবি সদস্য লুঙ্গি ও গেঞ্জি পরে নেন। রাত ৯টার দিকে আক্রমণকারীরা মসজিদের কাঁচ ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করলে ৩ জন বিজিবি সদস্য কৌশলে বের হয়ে যান এবং রাস্তা পার হয়ে কিছু স্থানীয় ব্যক্তির সহায়তায় একটি বাড়িতে আশ্রয় নেন। তখন বিক্ষুব্ধ জনতা নায়েক মো. আব্দুল আলীম শেখকে (রেজিস্ট্রেশন নম্বর-৬১৪১১) আক্রমণ করে ঘটনাস্থলে হত্যা করে। পরে মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।
ওই হামলায় আরও ৬৪ জন বিজিবি সদস্য গুরুতর আহত হন। বিজিবির ১টি জিপ, ৬টি পিকআপ, তিন টনের তিনটি ট্রাক, ১টি ম্যাজিস্ট্রেটের পিকআপ ও দুইটি বাস ভাঙচুর করে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এতে প্রায় ৪ কোটি ১২ লাখ ৯ হাজার ২৩৮ টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে মামলায় উল্লেখ করা হয়।
শিহাব খান/এমএসএ