শেখ সেলিমের আশীর্বাদে ব্যবসায়ী থেকে এমপি হয়ে যান আজাদ
২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ৬২ আসনে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাদের মধ্যে কুমিল্লা-৪ (দেবিদ্বার) আসন থেকে ব্যবসায়ী আবুল কালাম আজাদ নির্বাচিত হন। সাবেক সংসদ সদস্য ও নৌকা প্রতীকের প্রার্থী রাজী মোহাম্মদ ফখরুলকে পরাজিত করে জয়ী হয়ে সংসদে যান আজাদ। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার পালানোর পর ৬ আগস্ট রাষ্ট্রপতি সেই সংসদকে বিলুপ্ত ঘোষণা করেন।
আজাদের সংসদে যাওয়ার নেপথ্যে ছিলেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম। ব্যবসায়ী থেকে রাজনৈতিক উত্থানের শুরুতেই জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পদ পাওয়া, পরে উপজেলা চেয়ারম্যান এবং তারপর সংসদ সদস্য হওয়ার পেছনে ছিল শেখ সেলিমের জোরালো আশীর্বাদ। উত্তর জেলা আওয়ামী লীগ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্রটি জানিয়েছে, দেবিদ্বারের রাজনীতিতে হঠাৎ উত্থান হয় ঢাকা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কালাম আজাদের। আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারকদের অন্যতম শেখ সেলিমের দয়াতেই ২০২০ সালে উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পদে আসীন হন আজাদ। এর আগে আওয়ামী লীগে তার সামান্য একটা সদস্য পদও ছিল না। ২০২১ সালে প্রথমবারের মতো উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে বাজিমাত করেছিলেন আজাদ। ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে উপজেলা চেয়ারম্যান পদ থেকে অব্যাহতি নিয়ে প্রথমে নৌকার মনোনয়ন চান। নৌকা প্রতীকের টিকিট পেতে শেখ সেলিমকে বস্তায় ভরে টাকা দিয়েছিলেন আবুল কালাম আজাদ। কিন্তু রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড এবং গোয়েন্দা তথ্য নেতিবাচক থাকায় মনোনয়ন বোর্ডে নাম বাদ পড়ে আজাদের।
সূত্রটি আরও জানিয়েছে, আজাদকে নৌকার মনোনয়ন না পাইয়ে দিতে পেরেও হাল ছাড়েননি শেখ সেলিম। আজাদকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত করতে উঠেপড়ে লাগেন। শেখ সেলিমের কাছ থেকে গ্রিন সিগন্যাল পেয়ে নৌকা বঞ্চিত হয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নিজের মনোনয়ন নিশ্চিত করে নিজেকে প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দেন আজাদ। প্রতীক বরাদ্দের দিন ঈগল প্রতীক পেয়ে নেমে পড়েন ভোটের মাঠে। শুরু হয় আজাদের আসল খেলা।
শেখ সেলিমের প্রভাব খাটিয়ে একে একে ঘায়েল করতে থাকেন নৌকা প্রতীকের প্রার্থী রাজী মোহাম্মদ ফখরুলের অনুসারী ও সক্রিয় কর্মীদের। মামলা-হামলায় জর্জরিত করে এলাকা ছাড়া করেন নৌকার হয়ে কাজ করা নেতাকর্মীদের। তার রোষাণল থেকে বাদ যাননি জেলা আওয়ামী লীগের প্রবীণ ও শীর্ষ নেতারাও।
সূত্রটি জানিয়েছে, এসবের নেপথ্যে ছিলেন শেখ সেলিম। নির্বাচনের মাঠে কাজ করা প্রশাসনকে ফোন করে সর্বোচ্চ চাপে রেখেছিলেন তিনি (শেখ সেলিম)। আজাদ ও তার অনুসারীদের দেওয়া একটি রোডম্যাপ চাপিয়ে দেওয়া হয় প্রশাসনকে। শেখ সেলিম প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ফোন করে ওই রোডম্যাপ বাস্তবায়নের জন্য চাপ দিতেন প্রতিনিয়ত।
ওই নির্বাচনে কাজ করা প্রশাসনের একটি সূত্র ঢাকা পোস্টকে জানিয়েছে, নৌকা প্রতীকের প্রার্থী রাজী মোহাম্মদ ফখরুলের সক্রিয় কর্মী কুমিল্লা উত্তর জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক লিটন সরকারকে এলাকা ছাড়া করার আলটিমেটাম দেওয়া হয়। কুমিল্লা-৪ আসনের নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটির চেয়ারম্যান কুমিল্লার একজন যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজকে বেশ কয়েকবার ফোন করেছিলেন শেখ সেলিম। শেখ সেলিমের ফোনের চাপে এক রকম বাধ্য হয়ে লিটন সরকারকে এলাকা ছাড়া করা হয় প্রশাসনের লোক দিয়ে। শুধু লিটন সরকারই নয়, বেছে বেছে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সক্রিয় নেতাকর্মীদের এলাকা ছাড়া করা হয় শেখ সেলিমের চাপে।
প্রশাসনের সূত্রটি আরও জানিয়েছে, শুধুমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর নেতাকর্মীদের এলাকা ছাড়া করাই নয়, ভোটের দিন ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রের নাম করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অতিরিক্ত সংখ্যক লোক নিয়োজিত করে সেসব কেন্দ্রে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর কারচুপি বন্ধ রেখে বেশ কিছু ভোটকেন্দ্রে একক আধিপত্য দেখিয়ে ব্যাপক কারচুপি, এমনকি জাল ভোটের মহোৎসব করেছিলেন আজাদ। রিটার্নিং কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সব জায়গায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন আবুল কালাম আজাদ। তার নেপথ্যে শেখ সেলিমের বার বার ফোন করা।
এছাড়াও ভোটের দিন ভোটকেন্দ্র পরিদর্শনের সময় নৌকা প্রতীকের প্রার্থীকে অবরুদ্ধ করে রাখার দুঃসাহসও যুগিয়েছিল সেখ সেলিমের ভরসার হাত- এমনটাই ধারণা সংশ্লিষ্টদের।
দলের একটি সূত্র জানিয়েছে, ২০২০ সালে হঠাৎ দেবিদ্বারের রাজনীতিতে আবির্ভাব ঘটে ব্যবসায়ী আবুল কালামের। তার বাবা নূরুল ইসলাম দেবিদ্বার উপজেলার বরকামতা ইউনিয়নের ইউপি সদস্য থেকে ২০১৬ সালে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। আবুল কালাম আজাদ দেশের অন্যতম শিল্পগোষ্ঠী ঢাকা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। ব্যবসায়ী হিসেবে এলাকায় খ্যাত আবুল কালাম আজাদ কখনও রাজনীতিতে আসবেন এমনটা কখনোই ভাবেনি দেবিদ্বারের মানুষ। ২০২০ সালে কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পদে জায়গা পেয়ে প্রথম আলোচনায় আসেন আবুল কালাম আজাদ।
উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সূত্র বলছে, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নীতি নির্ধারক শেখ সেলিমের অনুগ্রহে উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ পদটি বাগিয়ে নেন আজাদ। পরের বছর দেবিদ্বার উপজেলা পরিষদের উপনির্বাচনে নিজেকে প্রার্থী ঘোষণা করেন ব্যবসায়ী আজাদ।
আরও পড়ুন
ওই উপনির্বাচনে শেখ সেলিমকে মোটা অংকের টাকা দিয়ে নৌকা প্রতীকের মনোনয়ন পান আজাদ। উপনির্বাচনে বিএনপি নেতা এএফএম তারেক মুন্সিকে ৩৬ হাজারের বেশি ভোটে পরাজিত করেন আজাদ। উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি পুরোদমে মাঠে নামেন। শেখ সেলিমের আনুগত্যের প্রভাব আর টাকার জোরে দেবিদ্বার আসনের তৎকালীন সংসদ সদস্য রাজী মোহাম্মদ ফখরুলের সঙ্গে চরম বিরোধে জড়িয়ে পড়েন। একে একে নিজের ছায়াতলে ভাগিয়ে নিতে থাকেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের।
দলীয় সূত্র বলছে, প্রথমে টাকার লোভ দেখিয়ে তাদের দলে ভেড়াতেন আজাদ। টাকায় কাজ না হলে প্রয়োগ করতেন ঘায়েল করার কূটকৌশল। মামলা-হামলায় জর্জরিত করে অনেককে এলাকা ছাড়তেও বাধ্য করা হয়। শেখ সেলিমের প্রভাব খাটিয়ে কৌশলে ধীরে ধীরে উপজেলার সিংহভাগ আওয়ামীপন্থি জনপ্রতিনিধি, পদহীন রাজনীতিবিদ এমনকি শিক্ষকদের নিজের ছায়াতলে নিয়ে স্বল্প সময়ে দেবিদ্বারে নিজের রাজনৈতিক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন আজাদ।
সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর নিজের ছোট ভাই মামুনুর রশীদকে উপজেলা চেয়ারম্যান বানাতে মরিয়া হয়ে ওঠেন আবুল কালাম আজাদ। গত ২৯ মে অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দেবিদ্বার উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন আজাদের আপন ছোট ভাই মামুনুর রশীদ। মামুনকে জয়ী করার মধ্য দিয়ে একই উপজেলায় এক পরিবারের তিন সদস্য জনপ্রতিনিধি হওয়ার রেকর্ডটি ভাগিয়ে নেন সাবেক সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদ।
সূত্রটি আরও বলছে, সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর বেপরোয়া হয়ে ওঠেন আবুল কালাম আজাদ। উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ম. রুহুল আমিন থেকে শুরু করে সাধারণ সম্পাদক রোশন আলী মাস্টারসহ দলের শীর্ষ নেতাদের মামলা, হামলা ও গাড়ি ভাঙচুর করে কোণঠাসা করতে থাকেন।
চলতি বছরের মার্চের শুরুর দিকে ৭ মার্চে উদযাপন উপলক্ষ্যে আয়োজিত সভা শেষে উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ম. রুহুল আমিনের গাড়িবহরে হামলা করা হয়। ওই মিটিংয়ে আবুল কালাম আজাদকে আমন্ত্রণ না জানানোর ক্ষোভে তার নির্দেশে হামলা করা হয়। ওই হামলায় উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক সাইফুল ইসলাম রাজীবসহ বেশ কয়েকজন মারাত্মক আহত হন। পরে হামলার অভিযোগে উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পদ থেকে অপসারণ করা হয় সাবেক এই সংসদ সদস্যকে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় দেবিদ্বারে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আবুল কালাম আজাদ। গত ৪ আগস্ট দেবিদ্বার পৌর সদরে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ মিছিলে প্রকাশ্যে গুলি চালাতে দেখা গেছে আজাদকে। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর গা ঢাকা দিয়েছেন সাবেক এই সংসদ সদস্য। তার মুঠেফোনটি বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। এখন পর্যন্ত আবুল কালাম আজাদের বিরুদ্ধে দুটি হত্যা ও হত্যাচেষ্টার মামলা দায়ের করা হয়েছে।
কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ এক নেতা নাম না প্রকাশ করার শর্তে ঢাকা পোস্টকে বলেন, দলের ত্যাগী ও আদর্শবান নেতাদের বাদ দিয়ে হাইব্রিড এসব লোকদের প্রাধান্য দেওয়ার কারণে আওয়ামী লীগ সারাদেশে আজ ক্ষতিগ্রস্ত। আবুল কালাম আজাদ হঠাৎ রাজনীতিতে এসে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেওয়া দলের প্রবীণ ও ত্যাগী নেতাদের নাজেহাল করেছিলেন। তার রোষাণল থেকে বাদ যাননি এমন একজন আদর্শিক নেতা নেই।
আরএআর