‘দাবি করলে কি সন্তানকে কেউ ফিরিয়ে দিতে পারবে, এ ক্ষমতা কারো আছে?’
‘ছেলে দাবি করলে কি আমার সন্তানকে কেউ ফিরিয়ে দিতে পারবে, এই ক্ষমতা কারো আছে? সন্তানের মতো কিছু হইবে আর? আমার সন্তান চলি গেইছে। আমার ছেলেকে যারা গুলি করে মারছে তাদের বিচার চাই।’
এভাবেই কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় ঢাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত আব্দুর রউফের (২৭) মা সুলতানা বেগম। ছেলে হারানোর শোকে রউফের বাবা-মা এখন দিশাহারা, চোখে-মুখে অন্ধকার দেখছেন তারা।
গত ১৮ জুলাই ঢাকার উত্তরায় সহিংসতার ঘটনায় সন্ধ্যা ৬টার দিকে গুলিবিদ্ধ হয়ে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে মারা যান রউফ। পরদিন দুপুর ১১টার দিকে নিজ জেলা নীলফামারী সদরের কচুকাটা ইউনিয়নের দোনদরী মাঝাপাড়া পারিবারিক কবরস্থানে তার দাফন সম্পন্ন হয়।
রউফ ওই গ্রামের ইউনুছ আলী (৫৮) ও সুলতানা বেগম (৫০) দম্পতির ছেলে। বাবা ইউনুছ পেশায় একজন রাজমিস্ত্রী। পরিবারে দুই ভাই এক বোনের মধ্যে রউফ সবার বড়। তার আয়ে পরিবার ও ছোট ভাইয়ের পড়ালেখা চলে। বিয়ে হয়েছে বোন রিমু আক্তারের (২২)। সবার ছোটভাই সাকিব হাসান (২০) এইচএসসি পাসের পর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির চেষ্টা করছেন। ছোট ভাইয়ের পড়ার খরচ ও পরিবারের অভাব মেটাতে আব্দুর রউফ বেছে নেন গাড়ি চালকের কাজ। এ জন্য তিনি ঢাকার উত্তরায় থাকতেন।
জেলা শহর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে আব্দুর রউফের বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, মা সুলতানা বেগম এখনো তার ঘরে ছেলেকে খোঁজেন। ভাঙাচোরা টিনের ঘরের বাঁশের বেড়া ধরে দরজায় দাঁড়িয়ে ছেলের অপেক্ষায় ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকেন সকাল-সন্ধ্যা। ঘটনার এক মাসের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও এখনো শোকে মুহ্যমান তার পরিবারের সদস্যরা।
তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার ছেলে যেদিন গুলি খাইছে, তার আগেরদিন কথা হইছিল। সে দিনে একবার আরে রাতে রাতে একবার ফোন দিত। যেদিন গুলি খাইছে সেদিন আমার সঙ্গে কোনো কথা হয়নি। আমার ফোনে কল দিছিল আমি রিসিভ করিনি। পরের দিন দেখছি যে অমুক টাইমে গতকাল সে ফোন দিছিল। আমার জামাইকে ফোন দিছে। বেটিকে ফোন দিছে, আমার নাতির সঙ্গে কথা কইছে, ছোট ছেলের সঙ্গে কথা কইছে। আমার সঙ্গে কথা হয় নাই আর ওর আব্বার সঙ্গে কথা হয় নাই। আমার ছেলেতো আমার সম্পদ আছিল। ১০-১১ বছর ধরে চাকরি করে ঢাকাত। সে তো আমার সম্পদ। সম্পদ আমার নাই, চলে গেইছে। প্রত্যেক মাসে ২০ হাজার করে টাকা দিত। তার নিজের জন্য কিছু করে নাই। সংসারেই দিছে, মেয়েকে বিয়ে দেওয়াইছে, ছোট ছেলেটার লেখাপড়ার খরচ দেয়। আমার সংসার চালায়। আমাদের ওষুধ পাতি যা কিছু লাগে সব দেয়। ছেলে মারা যাওয়ার পর আমরা এতো অসহায় হয়ে গেছি। ছেলের শোক তো আছেই, আমরা যে মানুষগুলো চলবো তার কোনো ব্যবস্থা নাই। ছোট ছেলে তো লেখাপড়া করে, সে তো কোনো কিছু করতে পারবে না। এখন আমি কি করে চলবো। আমাদের দুইজনের প্রতি মাসে ৫-৬ হাজার টাকার ওষুধ লাগে।
রউফের বাবা ইউনুছ আলী বলেন, দিনমজুর হওয়ার কারণে ছেলেকে বেশি পড়ালেখা করাতে পারিনি। সংসারে অভাবে থাকায় সে ঢাকায় গাড়ি চালিয়ে আমাদের সংসার চালাতো। মেয়েকে বিয়ে দিছে সে, ছোট ছেলেকে পড়ালেখা করাইছে। প্রতি মাসে ২০ হাজার টাকা পাঠাতো। সেই টাকা দিয়ে আমার পরিবার চলতো। ছেলের মৃত্যুর সঙ্গে আমার সব স্বপ্ন মরে গেছে। তাকে ছাড়া আমি এখন বাঁচবো কীভাবে? আমার ছেলে দেশের জন্য জীবন দিল, কিন্তু কেউ আমাদের খোঁজ নিতে আসেনি।
ছোট ভাই সাকিব বলেন, গত ১৮ জুলাই দুপুরে ফোনে ভাইয়ের সঙ্গে (রউফ) আমার কথা হয়েছিল। ভাই বাড়ির সবার খোঁজ-খবর নিয়েছিল। সে সময়ের পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি আমাকে সতর্ক করেছিল। এরপর সন্ধ্যায় তিনি নিজেই হারিয়ে গেলেন আমাদের ছেড়ে।
কচুকাটা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুর রউফ চৌধুরী বলেন, ওই ছেলে এলাকায় সহজ সরল হিসেবে পরিচিত ছিল। সে ঢাকার উত্তরার একটি প্রতিষ্ঠানে ড্রাইভার হিসেবে চাকরি করতো। গত ১৮ জুলাই সন্ধ্যায় গুলিবিদ্ধ হয়ে ঢাকাতেই মারা যায়। তার বাবা-মা দুইজনই অসুস্থ। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ছিল সে।
শরিফুল ইসলাম/এফআরএস