নারায়ণগঞ্জে বাড়ছে বিএনপির অন্তর্কোন্দল
অন্তর্কোন্দল বেড়েছে নারায়ণগঞ্জ বিএনপিতে। আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি, বিসিক ও আদমজী ইপিজেডে ব্যবসা, বিভিন্ন পোশাক কারখানার ঝুট ব্যবসাসহ নানা ইস্যুতে বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদলসহ এর অঙ্গ-সংগঠনের নেতাকর্মীদের মধ্যে বেড়েছে এ কোন্দল। ফলে নিজেদের মধ্যে ঘটছে সংঘর্ষের ঘটনাও। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে হত্যা মামলা দিয়ে আসামি করা হচ্ছে একে-অপরকে। এতে হতাশ সাধারণ নেতাকর্মীসহ এলাকাবাসী।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত সাড়ে ১৭ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে বিএনপি। এ সময় বিএনপি ও এর অঙ্গ-সংগঠনের নেতাকর্মীরা মামলা-হামলায় নাস্তানাবুদ হয়ে পড়েন। অনেকেই অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। এরই জেরে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার জনরোষে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বিএনপি ও এর অঙ্গ-সংগঠনের নিপীড়িত নেতাকর্মীরা তাদের সাড়ে ১৭ বছরের লোকসান পুষিয়ে নিতে এবং এলাকায় আধিপত্য ধরে রাখতে বিভিন্ন এলাকায় মহড়ার পাশাপাশি বিভিন্ন শিল্পকারখানায় নিজেদের অবস্থান জানান দিতে থাকেন। এ কারণে নিজেদের মধ্যে ঘটে অন্তর্কোন্দল। যা একপর্যায়ে রূপ নেয় হামলা-মামলায়।
গত ৬ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জের বন্দরে মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট আবু আল ইউসুফ খান টিপুর ওপর হামলা করেন তারই দলের নেতাকর্মীরা। টিপুর ওপর হামলার বিষয়ে জানতে চাইলে মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান বলেন, ‘বন্দরের বহিষ্কৃত বিএনপিনেতা আতাউর রহমান মুকুল ও আবুল কাউসার আশারা জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে এ হামলা চালায়। হামলায় আরও যারা যুক্ত তাদের তথ্যও আছে আমাদের কাছে। এ ব্যাপারে আইনগতভাবে এবং দলীয়ভাবে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
একই দিন সিদ্ধিরগঞ্জের ১নং ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সালাউদ্দিন ওরফে চাইল সালাউদ্দিনের ভাই কামালকে চাঁদাবাজির সময় হাতেনাতে ছাত্র-জনতা আটক করেন। পরে তাকে সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেয়া হয়।
অপরদিকে, ৬ সেপ্টেম্বর ‘সিদ্ধিরগঞ্জের বিএনপিনেতা আকবরের আগ্রাসী লুটপাটের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াও’ ব্যানারে মানববন্ধন চলাকালে হামলার ঘটনা ঘটে। এ সময় মানববন্ধনে অংশগ্রহণকারীদের মারধর করেন বিএনপি নেতা আকবর ও তার অনুসারীরা। আকবর বাহিনীর হামলায় শ্রমিকনেতা আলমগীর হোসেন ও নারী-পুরুষসহ অন্তত ১০ জন আহত হন। সাংবাদিকদেরও এ সময় লাঞ্ছিত করা হয়।
একই দিন রূপগঞ্জে আধিপত্য বিস্তার ও পোস্টার সাঁটানো নিয়ে স্বেচ্ছাসেবক দল ও যুবদলের নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় সাতজন আহত হন। কয়েকজন নেতাকর্মীর বাড়িঘরে ভাঙচুর ও লুটপাটের অভিযোগও পাওয়া যায়।
রূপগঞ্জ উপজেলা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক কামরুল হাসান এ প্রসঙ্গে বলেন, বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে বিভিন্ন জায়গায় পোস্টার লাগানো হয়। কিন্তু রাতে উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্য সচিব আলী আহমেদের লোকজন ইছাখালী বাজারে সাঁটানো পোস্টার ছিঁড়ে ফেলেন। এ সময় বাধা দিলে তাদের সঙ্গে আমার বাকবিতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে তারা আমার বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট করে।
তবে উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্য সচিব আলী আহমেদ বলেন, ‘রূপগঞ্জ উপজেলা যুবদলের সদস্য সচিব বাবুল, রূপগঞ্জ উপজেলা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক কামরুল হাসান, কায়েতপাড়া ইউনিয়ন যুবদলের সভাপতি কামাল নাসেরের নেতৃত্বে আমার মোটরসাইকেলে আগুন দেয়া হয়। তারা আমার একটি প্রাইভেটকার ভাঙচুর করে। এলাকায় প্রভাব বিস্তারের জন্যই তারা আমার লোকজনকে পিটিয়ে আহত করে।’
গত ২৯ আগস্ট স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা রাসেল মাহমুদ ও জাহাঙ্গীর গ্রুপ ফতুল্লার শিল্পাঞ্চল বিসিক-১ নম্বর গলিতে ঝুট ব্যবসার দখল নিতে সংঘর্ষে জড়ায়। এ সময় জাহাঙ্গীর গ্রুপের দুজনকে ছুরিকাঘাত করে রাসেল গ্রুপের লোকজন। পরবর্তীতে অতিরিক্ত পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
১৫ আগস্ট সিদ্ধিরগঞ্জের আদমজী ইপিজেডের একটি কারখানার ১২ ট্রাকভর্তি ঝুট ও তিন ট্রাক কার্টুন ও পলি আদমজী ইপিজেডে থেকে বের করার সময় প্রতিপক্ষ আটক করে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় সোপর্দ করে। এ সময় দুপক্ষের মধ্যে আক্রমণাত্মক পরিস্থিতি তৈরি হয়। পরবর্তীতে পুলিশের মধ্যস্থতায় উভয় গ্রুপ শান্ত হলে রাতে শাহেদ গ্রুপ মালামালবাহী ট্রাকগুলো ছাড়িয়ে নেয়।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে নতুন করে দল গোছাতে শুরু করে নারায়ণগঞ্জ বিএনপি ও এর অঙ্গ-সংগঠনগুলো। কিন্তু এর মধ্যেই নিজেদের মধ্যে চাঁদাবাজি, ঝুট ব্যবসা ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে প্রতিনিয়ত কোন্দলে জড়িয়ে পড়ায় চিন্তিত দলের স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ।
নারায়ণগঞ্জ বিএনপির অন্তর্কোন্দলের বিষয়ে জানতে চাইলে মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বিএনপিতে যারা আন্দোলন-সংগ্রামে ছিলেন, ১৫ বছর কষ্ট করেছেন, তাদের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। তারা সবাই ঐক্যবদ্ধ। কিন্তু কিছু সুবিধাবাদী যারা এই ১৫ বছর আওয়ামী লীগের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে নিজেদের আখের গুছিয়েছেন, আওয়ামী লীগের পক্ষ নিয়ে বিএনপির নেতাকর্মীদের হয়রানি করেছেন, তারা এখন বিএনপি সেজে আমাদের নেতাকর্মীদের হয়রানি করছেন। এজন্য কিছু কিছু জায়গায় ঝামেলা হচ্ছে। এটা সাময়িক ব্যাপার। আশা করি পরিস্থিতি দ্রুতই স্বাভাবিক হবে।’
কোন্দল নিরসনের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘দলের মধ্যে যেন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না হয় এজন্য আমরা কাজ করছি। আমাদের কেন্দ্রীয় কমিটিও বিষয়টি অবজারভেশনে রেখেছেন। যারা দলকে প্রশ্নবিদ্ধ করবেন, যারা দলের বিরুদ্ধে কাজ করবেন, অনৈক্য সৃষ্টি করবেন, তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। যারা বিশৃঙ্খলা করছেন, আশা করি এসব ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে তারা সংযত হয়ে যাবেন। সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকবেন।’
মেহেদী হাসান সৈকত/এমটিআই