তিস্তা পাওয়ার প্ল্যান্ট প্রকল্পে প্রশাসক নিয়োগের দাবিতে লং মার্চ
বেক্সিমকো পাওয়ার কোম্পানির নির্মিত তিস্তা পাওয়ার প্ল্যান্ট প্রকল্পের স্বচ্ছতা নিরূপণে প্রশাসক নিয়োগ করে জমি দখল ও খুনের ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের শাস্তিসহ সাত দফা দবিতে ‘লং মার্চ টু তিস্তা’ কর্মসূচি পালন করেছে নদীপাড়ের মানুষ। কর্মসূচি থেকে ক্ষুধা, মঙ্গা ও বন্যা প্রতিরোধে পানির ন্যায্য হিস্যা প্রাপ্তি ও তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নেরও দাবি জানানো হয়।
শনিবার (৭ সেপ্টেম্বর) দুপুরে রংপুরের পীরগাছা ও গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের তিস্তাপাড়ের কয়েক হাজার মানুষ বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সুন্দরগঞ্জে তিস্তা পাওয়ার প্ল্যান্ট ঘেরাও করে মানববন্ধন সমাবেশ করেন। সেখানে বিভিন্ন ধরনের প্ল্যাকার্ড এবং ব্যানার ব্যবহার করেন আন্দোলনকারীরা।
মানববন্ধনে বক্তব্য দেন, পীরগাছার ছাওলা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নজির হোসেন, তাম্বুলপুর ইউপির চেয়ারম্যান বজরুল রশিদ মুকুল, অ্যাডভোকেট শেখ শোভন, শিক্ষার্থী মাহিন, শরিফুজ্জামান ডালেস, মশিউর রহমান, শামছুল মিয়া প্রমুখ।
সমাবেশে বক্তারা বলেন, বেক্সিমকো পাওয়ার কোম্পানি অস্বচ্ছভাবে তিস্তা পাওয়ার প্ল্যান্ট প্রকল্প পরিচালনা করছে। স্বচ্ছতা নিরূপণে প্রশাসক নিয়োগ করতে হবে। প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণকালে অস্ত্রের মুখে নিরীহ মানুষকে জিম্মি করে জমি দখল, খুনসহ জমি বিক্রি করতে বাধ্য করার বিষয়ে সালমান এফ রহমানসহ জড়িতদের শাস্তি দিতে হবে।
বিক্ষুব্ধ জনতা আরও বলেন, কোম্পানির উৎপাদিত বিদ্যুতের সঠিক হিসাব, ব্যবস্থাপনা ও স্থানীয় বিদ্যুতের চাহিদাপূরণ-পরবর্তী সুষ্ঠু বণ্টনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করে স্থানীয় বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করতে হবে। তিস্তার বুকে নির্মিত তিস্তা বিদ্যুৎ প্রকল্পের আড়ালে ভারতীয় গুপ্তচর ব্যবহার করে এ অঞ্চলকে অশান্ত করার পাঁয়তারা করা হচ্ছে। উত্তর জনপদকে রক্ষা করতে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন আজ সময়ের একচ্ছত্র দাবি। তিস্তার গতিপথ নিয়ন্ত্রণে যেখানে প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন, কিন্তু দুঃখের বিষয় প্রাণোচ্ছ্বল নদীটির গতিপথকে ব্যাহত করে পরিবেশ ও স্থানীয় জনতার স্বার্থ পরিপন্থি কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা হয়েছে পতিত স্বৈরাচারের আমলে।
মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, আওয়ামী লীগ নেতা শিল্পপতি সালমান এফ রহমান গং বিগত বছরগুলোতে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে তিস্তাপাড়ের অসহায় মানুষদের নিজ ভূমি থেকে উৎখাত করে আসছিল। বেক্সিমকো সোলার পাওয়ার কর্তৃক নির্মিত অস্বচ্ছ তিস্তা পাওয়ার প্ল্যান্টের সকল দুর্নীতি উন্মোচন ও বিদ্যুতের সঠিক হিসাব নিরূপণে তিস্তাপাড়ের সন্তানদের দায় মোচনের সময় এসেছে। জমিহারা হতভাগা মানুষদের অধিকার ফিরিয়ে দিতে সাধারণ ছাত্র-জনতা বদ্ধ পরিকর। তিস্তার বুকে নির্মিত এ প্রকল্পের আড়ালে প্রয়োজনের অতিরিক্ত ভারতীয় শ্রমিকের উপস্থিতি এবং দেশীয় শ্রমিক-কর্মচারীদের প্রতি বৈষম্য নিরসনে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণেরও দাবি জানানো হয়।
এ সময় সাত দফা দাবি তুলে ধরা হয়। দাবিগুলো হলো—১. ক্ষুধা, মঙ্গা ও বন্যা প্রতিরোধে পানির ন্যায্য হিস্যা প্রাপ্তি ও তিস্তা মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করো, করতে হবে। ২. ‘বেক্সিমকো পাওয়ার কোম্পানি’ কর্তৃক নির্মিত অস্বচ্ছ তিস্তা পাওয়ার প্লান্টে প্রকল্পের স্বচ্ছতা নিরূপণে অনতিবিলম্বে রাষ্ট্রীয় তদারকি কায়েম করা হোক। ৩. প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণকালে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে দখলকৃত এবং অবমূল্যায়িত নদীবিধৌত জমির মালিকদের ন্যায্য অধিকার দ্রুত বাস্তবায়ন করা হোক। ৪. জমি দখলকল্পে যে খুনের ঘটনা ঘটেছে তাতে লুটেরা সালমান এফ রহমানসহ জড়িত সকলের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করে মজলুমদের প্রতি ন্যায়বিচার নিশ্চিত হোক। ৫. কোম্পানির উৎপাদিত বিদ্যুতের সঠিক ব্যবস্থাপনা ও স্থানীয় বিদ্যুতের চাহিদাপূরণ-পরবর্তী সুষ্ঠু বণ্টনের ব্যবস্থা নিশ্চিতে রাষ্ট্রের সরাসরি হস্তক্ষেপ কায়েম হোক। ৬. অধিকতর বৈদেশিক বিনিয়োগের মাধ্যমে তিস্তা অববাহিকায় নদীবান্ধব শিল্পের বিকাশের মাধ্যমে প্রশিক্ষিত কর্মীদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করাই অনিবার্য দাবি। ৭. মুক্তিকামী আপামর ছাত্রজনতা লুটেরাদের অবৈধ সম্পদের উৎস নিরূপণে রাষ্ট্রীয় জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণে প্রয়োজনে আদালতের সুদৃঢ় হস্তক্ষেপ কামনা।
এদিকে সিভমেক ইঞ্জিনির্য়াস লিমিটেডের প্রজেক্ট ম্যানেজার মো. আজিজুল হক বলেন, এই প্রকল্পটা যখন টেন্ডার করা হয় সেটা ছিল আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়ায়। সেই সুবাদে ভারতীয় কোম্পানি কাজটা পেয়েছে। এখানে ভারতীয় কোম্পানি রেইস পাওয়ার ইনফাকচার প্রাইভেট লিমিটেড প্রকল্প পরিচালনা করার জন্য ভারতীয় প্রকৌশলী কর্মরত ছিলেন। প্রথম দিকে ২০ থেকে ২২ জন কর্মরত থাকলেও শেষের দিকে এসে ১০ জন পর্যন্ত ছিলেন। ছাত্র-জনতার বিপ্লবের পর তারা সকলেই ছুটি নিয়ে ভারতে ফিরে গেছেন। সেখান থেকে মোবাইলের মাধ্যমে কাজ পরিচালনা করছেন। ভারতীয় কোম্পানি হলেও মূলত আমাদের দেশীয় বিভিন্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে কাজগুলো করিয়েছেন। চলমান কাজ শেষ হতে আরও কমপক্ষে দুই বছর লাগতে পারে।
তিনি আরও বলেন, এখান থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হচ্ছে। সেখান থেকে বিদ্যুৎ বণ্টন করা হচ্ছে। এর সুফল আমাদের দেশের মানুষই পাচ্ছে। ২০২২ সালের ২৮ ডিসেম্বর থেকে প্রকল্পটি চালু করা হয়েছে।
তিস্তা সোলার লিমিটেডের সিনিয়র ম্যানেজার (অ্যাডমিনিস্টেশন অ্যান্ড সিকিউরিটি) সাজিদ জাকির বলেন, শিক্ষার্থীদের তোলা কিছু দাবি আমাদের প্রতিষ্ঠানের পক্ষে বাস্তবায়ন করা সম্ভব, সেগুলো আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাবো। আবার কিছু কিছু দাবির ক্ষেত্রে নির্বাহী আদেশের ব্যাপার রয়েছে।
মানববন্ধন শেষে শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো নিয়ে পাওয়ার প্ল্যান্টে জরুরি সভা করা হয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন পীরগাছা উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) ইফতিসাম প্রীতি। সভায় সুন্দরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. তরিকুল ইসলাম বলেন, আমাদের কাছে শিক্ষার্থীরা লিখিতভাবে তাদের দাবিগুলো জানালে আমরা সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে পাঠিয়ে দেব।
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এএমকে