নওগাঁয় হাসকিংয়ে কমলেও অটো রাইস মিলে কমেনি চালের দাম
ধান-চালে সমৃদ্ধ উত্তরের জেলা নওগাঁ। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর গত দুই সপ্তাহের ব্যবধানে এ জেলায় প্রতি মণ ধানের দাম কমেছে একশ থেকে দেড়শ টাকা। যার প্রভাবে ১ সপ্তাহের ব্যবধানে মানভেদে প্রতি কেজি চালের দাম ১-২ টাকা কমিয়েছে হাসকিং মিল মালিকরা। স্বাভাবিকভাবে এই সময়ে অটোমেটিক রাইস মিলগুলোতেও চালের দাম কমে আসার কথা। এরপরও চালের দাম কমাতে সময়ক্ষেপণের অভিযোগ উঠেছে জেলার অটোমেটিক রাইস মিল মালিকদের বিরুদ্ধে।
অটোমেটিক রাইস মিল মালিকদের দাবি, সম্প্রতি ধানের দাম যতটুকু কমেছে সেই প্রভাব তাদের মিলগেটে পড়তে সময় লাগবে আরও ৪-৫ দিন। পূর্বে বেশি দামে কেনা ধান থেকে উৎপাদিত চাল এখনো মিলে রয়ে গেছে। ওইসব চাল বের হওয়ার পর পর্যায়ক্রমে কম দামে কেনা ধান থেকে উৎপাদিত চাল বাজার মূল্যের সঙ্গে সমন্বয় করে বিক্রি করা হবে।
খাদ্য বিভাগের তথ্য মতে, এক দশক আগে হাজারের অধিক চালকল থাকলেও বর্তমানে এ জেলায় সচল চালকল রয়েছে ৩৫৬টি। এর মধ্যে ৪৪টি অটোমেটিক রাইস মিল। বাকি ৩১২টি হাসকিং মিল হিসেবে পরিচালিত হচ্ছে। এসব হাসকিং মিল একত্রে সারা বছরে যে পরিমাণ চাল উৎপাদনে সক্ষম জেলায় বর্তমানে সচল অটোমেটিক রাইস মিলগুলোর চাল উৎপাদনের সক্ষমতা তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি।
শহরের সুলতানপুর মহল্লার বিভিন্ন মিলগেট ঘুরে দেখা যায়, ধানের দাম কমে আসায় হাসকিং ও অটোমেটিক রাইস মিলগুলোতে জেলার বিভিন্ন হাট বাজার থেকে কেনা ধানবোঝাই ট্রাক দিনভর প্রবেশ করছে। এসব ট্রাক থেকে ধান নামিয়ে চাতালে শুকানোর কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন শ্রমিকরা। হাসকিং মিলগুলোতে কর্মব্যস্ততা বেড়েছে চাতাল শ্রমিকদের। অটোমেটিক রাইস মিলগুলোতেও পুরোদমে চলছে কাজ। মৌসুমের শেষ মুহূর্তে এসেও যেন এসব মিল হঠাৎই প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে।
পার নওগাঁ মহল্লার আড়তদারপট্টি ঘুরে দেখা যায়, মোকামে বর্তমানে পাইকারী পর্যায়ে মানভেদে প্রতি কেজি জিরাশাইল ৬২-৬৪ টাকা, কাটারীভোগ ৬২-৭০ টাকা, সুভলতা ৫৯-৬১ টাকা এবং স্বর্ণা-৫ জাতের চাল ৫০-৫২ টাকা দরে কেনাবেচা হচ্ছে। এর মধ্যে হাসকিং মিলে উৎপাদিত জিরাশাইল, কাটারীভোগ ও সুভলতা জাতের চালের দাম প্রতি কেজিতে কমেছে ১-২ টাকা। চালের বস্তায় জাত, দাম, ওজন ও উৎপাদনের তারিখ উল্লেখ রাখার নিয়মকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে চাল কেনাবেচা করতে দেখা গেছে ব্যবসায়ীদের।
দেশমূখ্য ট্রেডার্সের আড়তদার বিশ্বপ্রসাদ দেশমূখ্য বলেন, বর্তমানে হাসকিং মিল থেকে প্রতি কেজি পলিশ বিহীন জিরাশাইল ও কাটারীভোগ চাল ৫৯-৬০ টাকা দরে কেনা হচ্ছে। এসব চাল পলিশ করার পর প্রতি কেজি বিক্রি করা হচ্ছে ৬২ টাকায়। সুভলতা ৫৭ টাকা কেজি দরে কেনার পর পলিশ করে ৫৯ টাকা কেজি দরে বিক্রি করা হচ্ছে। হাসকিং মিলে উৎপাদিত এসব চালের দাম প্রতি কেজিতে ১-২ টাকা কমেছে। এরপরও মোকাম ক্রেতাশূন্য। আগে প্রতিদিন একশ থেকে দেড়শ ট্রাক চাল ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন মোকামে যেত। এখন দৈনিক ৩০-৪০ ট্রাক চাল বিক্রি হচ্ছে।
সততা রাইস এজেন্সির আড়তদার সুকুমার ব্রহ্ম বলেন, গত বোরো, আউশ ও আমন মৌসুমে ১৭ লাখ টন চাল উৎপাদনে সক্ষম ধান উৎপাদিত হয়েছে নওগাঁয়। আমাদের স্থানীয় পর্যায়ে চালের চাহিদা রয়েছে মাত্র ৬ লাখ টন। তাই বন্যা পরবর্তী সময়ে অবৈধভাবে মজুত রেখে কেউ বেশি দামে চাল বিক্রি করার চেষ্টা করছে কি না সে বিষয়ে প্রশাসনের নজরদারি বাড়াতে হবে। এখানে কোনো সংকটের সুযোগ নেই। চালের বাজার অস্থিতিশীল হলে তাৎক্ষণিক মজুতবিরোধী আইন অনুযায়ী অবৈধ মজুতকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
মোল্লা অটোমেটিক রাইস মিলের স্বত্ত্বাধিকারী হাসান মোল্লা বলেন, দেশে চলমান বন্যা পরিস্থিতির কারণে মোকামে চাল কেনাবেচা একেবারেই কমে গেছে। আগের সরকারের আমলে চালের বস্তায় জাত, পরিমাণ, দাম ও উৎপাদনের তারিখ উল্লেখ রাখার বিষয়টি কড়াকড়ি করার প্রক্রিয়া চলছিল। বর্তমানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্বে খাদ্য মন্ত্রণালয় থাকায় ওই বিষয় বহাল রাখা বা নতুন কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। তাই মিলগেট এবং মোকামে যেসব চাল বিক্রি হচ্ছে সেখানে পূর্বের নিয়ম আপাতত মানা হচ্ছে না।
নওগাঁ জেলা অটোমেটিক রাইস মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক তৌফিকুল ইসলাম বাবু ঢাকা পোস্টকে বলেন, অটোমেটিক রাইস মিল সচল রাখতে যে পরিমাণ ধানের প্রয়োজন এখনো সেই পরিমাণে ধান বাজারে সরবরাহ নেই। প্রয়োজনের তুলনায় অর্ধেক ধান কিনে মিল সচল রাখতে হচ্ছে। ধানের দাম কিছুটা কমেছে। তবে সহসাই সেই প্রভাব মিলগেটে পড়বে না। মিলগেটে চালের দাম কমতে আরও ৩-৪ দিন সময় লাগবে।
তিনি বলেন, এ বছর ধানের পর্যাপ্ত ফলন হয়েছিল। তাই সংকট সৃষ্টির সুযোগ নেই। তবে বন্যা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে কেনাবেচা হুট করে বেড়ে যেতে পারে। কেনাবেচা বাড়লে স্বাভাবিকভাবেই চালের দাম আগামীতে আরও কিছুটা বাড়বে। তবে সেটা সহনশীল পর্যায়েই থাকবে বলে আশা করছি। উত্তরের জেলাগুলো বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত না হলে খাদ্য ঘাটতির কোনো শঙ্কা থাকবে না বলেও জানান তিনি।
আরমান হোসেন রুমন/আরএআর