সালমানের পেটে এখনও রয়ে গেছে গুলি, দুশ্চিন্তায় বাবা
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিয়ে গুলিবিদ্ধসহ বিভিন্নভাবে আহত অনেকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। হাসপাতালটির বেডে শুয়ে-বসে দিন কাটছে আহতদের।
তবে প্রিয় সন্তানদের এমন পরিণতিতে স্বজনদের মধ্যে ক্ষোভ-হতশা না থাকলেও তাদের মুখে বিজয়ের গল্প। স্বজনরা বলছেন, সন্তানরা বীরের মতো কাজ করছে। তাদের জন্য তেমন চাওয়া-পাওয়া নেই। সন্তানের সুস্থতাই এখন তাদের এক মাত্র চাওয়া। সম্প্রতি সন্ধ্যায় হাসপাতালটিতে গিয়ে কয়েকজন আহত ও তাদের স্বজনদের সঙ্গে কথা হয়।
রামেক হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহত হয়ে বর্তমানে হাসপাতালটিতে ৮ জন চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এর মধ্যে রামেকের ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডে ৪ জন করে। হাসপাতালটির পক্ষ থেকে ওষুধ থেকে শুরু করে সবধরনের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। কর্তৃপক্ষের এমন উদ্যোগে সন্তুষ্ট আহতদের স্বজনরাও।
গত ৫ আগস্ট আন্দোলনে থাকাকালীন রাজশাহীর আলুপট্টি মোড়ের স্বচ্ছ টাওয়ারের নিচে হামলায় আহত হন মো. সালমান (২১)। তিনি রাজশাহী বঙ্গবন্ধু কলেজের ছাত্র। মো. সালমান বলেন, ‘পুলিশ ভায়েরা আমাদের ওপরে টিয়ার সেল নিক্ষেপ করে। আর সন্ত্রাসীদের হাতে রিভালবার ছিল। তারা আমাদের ওপরে গুলি ছোড়ে। এক পর্যায়ে আমার পেটে গুলি লাগে। আমার সামনে আরও দুই থেকে তিনজন গুলিবিদ্ধ হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাকে এক বড় ভাই তার বাইকে করে হাসপাতালে নিয়ে এসেছিলেন। আমি গুলি খাওয়ার পরে আধা ঘণ্টা দৌড়াদড়ি করে কয়েকজনকে বাঁচিয়ে ছিলাম। আমার পক্ষে যেটুকু সম্ভব ছিল। সেটা করেছি। আমাদের দেশে যেই সরকার প্রধান হোক সেটা দেখার বিষয় না। কোনো সরকার যদি অন্যায় করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। বাংলাদেশের মানুষ যেন শান্তিতে থাকতে পরে।’
মো. সালমান আরও বলেন, ‘আন্দোলনে সময় বাসায় ওইভাবে বলে যাইনি। প্রথম থেকেই আন্দোলনে ছিলাম। শেষ দিন ভেবে ছিলাম, হয় মারা যাব, না হয় দেশকে স্বাধীন করে ছাড়ব। এই রাকম নিয়াত নিয়ে মাকে বলে বের হয়েছিলাম। হয়তো আর নাও ফিরতে পারি।’
আহত সালমানের বাবা রবিউল ইসলাম রবি বলেন, ‘একটা অপারেশন হয়েছে। তবে এখনও গুলি বের হয়নি। গুলি তার এখনও পেটের মধ্যে আছে। ডাক্তারা (চিকিৎসক) আমাকে শান্তনা দিয়েছেন-কিছুদিন পরে আরেকটা ওটি করা লাগবে। যেহেতু গুলি বের করা সম্ভব হয়নি। বিষয়টি নিয়ে টেনশনে আছি। দেশের জন্য আন্দোলনে গিয়ে আমার ছেলের এই ক্ষতি হয়েছে। এটার জন্য আমার কোনো চাওয়া পাওয়া নেই। যারা জেলে আছে যা আহত হয়েছে তাদের জন্য দেশের মানুষ যেন দোয়া করে এটাই কামনা করি।’
আরও পড়ুন
চিকিৎসার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘হাসপাতালে চিকিৎসা ভালো চলছে। দেখা শোনা খুব ভালোভাবে করছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। চিকিৎসার জন্য কোনো ওষুধ কিনতে হচ্ছে না। সব হাসপাতাল থেকে দিচ্ছে।’
রাজশাহী জেলা গোদাড়ী উপজেলার গোল চত্বরে পায়ে গুলিবিদ্ধ হন রিয়াদ (২০)। রিয়াদ বলেন, ‘ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ঘিরে রেখেছিল। গোদাগাড়ী গোল চত্বর ঘিরে রেখেছিল পুলিশ। তারা গুলি ছুড়লে দ্বিতীয় গুলি আমার পায়ে লাগে। তখনই আমি মাটিতে পড়ে সেন্সলেস হয়ে যাই। পরে কী হয়েছে আমি জানি না।’ রিয়াদ গোদাগাড়ী স্কুল অ্যান্ড কলেজের এইচএসসির পরীক্ষার্থী। তার বাবা ওবায়দুল ইসলাম। তিনি পেশায় হোটেল ব্যবসায়ী।
রিয়াদ বলেন, ঘটনার দিন গোদাগাড়ী উপজেলা থেকে আমরা এক কিলোমিটার দূরে অবস্থান করি। বেলা ১১টার দিকে গোল চত্বরে এসে আমরা মিছিল করব। গোল চত্বরে পুরোটাই পুলিশ ঘিরে রেখেছিল। কাছে গেলে তারা টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। এতে ধোঁয়ায় চারপাশ ছেয়ে যায়। এ সময় সবাই দূরে সরতে শুরু করে। তখন তারা গুলি করলে দ্বিতীয় গুলিটা আমার পায়ে এসে লাগে। তখনই আমি মাটিতে পড়ে সেন্সলেস হয়ে গেছি। পরে গোদাগাড়ীতে কি হয়েছে আমার তা জানা নেই।
হাসপাতালের একই ওয়ার্ড চিকিৎসাধীন রয়েছেন অপর গুলিবিদ্ধ কৌশিক ইসলাম অপূর্ব (১৮)। শিক্ষাবোর্ড মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী। তার বাবা শফিকুল ইসলাম মারা গেছে ৬ বছর আগে। তার মাও প্যারালাইসড। তারা শিরোইল কলোনীতে থাকে।
ঘটনার দিনে গুলিবিদ্ধ হওয়ার বর্ণনায় কৌশিক ইসলাম অপূর্ব বলেন, ‘রাস্তার সাইডে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তখন গোলাগুলি হচ্ছিল। আমার পায়ে গুলি লেগেছিল। গুলি লাগার কারণে হাঁটার স্পিড কমে গেলে আমি একটু বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। তখন আমি একটা গলিতে ঢুকি। সেই গলিতে আমার ওপর আক্রমণ হয়। কিছু ছেলে রড, রামদা নিয়ে ঢুকেছিল। তারা আমার মাথা ও মুখে মারে। এতে চোয়ালের দুই সাইডো হাড় ভেঙে যায়। এই হাসপাতালে আসার পরে আমার দুই বার অপারেশন হয়েছে। একবার গুলি বের করা হয়েছে। আরেক বার চোয়াল ঠিক করার জন্য অপারেশন করা হয়েছে।’
কৌশিক ইসলাম অপূর্বর বিষয়ে তার খালা বলেন, ‘আমি আর কৌশিকের বড় বোন তার দেখাশোনা করছি। এছাড়া ওর অনেক বন্ধু-বান্ধবি আসছে হাসপাতালে অপূর্বকে দেখতে। এখানে তারা খুব কেয়ার করছে। নার্স, চিকিৎসকরা আসছে। তারা খুব ভালো চিকিৎসা দিচ্ছে।’
এ বিষয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগের মেডিকেল অফিসার ডা. শংকর বিশ্বাস বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনে গত ৫ তারিখে সবচেয়ে বেশি আহত ভর্তি হয়েছেন। অনেক রোগী চিকিৎসা নিয়েছে। পরবর্তীতে ১২৫ জনের একটি তালিকা আমরা করেছি। হাসপাতাল পরিচালকের নির্দেশনায় সবধানের ওষুধ সরবারহ করা হয়েছে। আমাদের সুদক্ষ একটা টিম করা হয়েছিল। সব বিভাগ সচল ছিল। দিন-রাত সবসময় কাজ করছে চিকিৎসকরা। বর্তমানে হাসপাতালে আটজন রয়েছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) সমন্বয়ক নওশাদ জামান বলেন, আমরা প্রথম থেকেই আহতদের খোঁজখবর রাখছি। অনেকেই চিকিৎসা নিয়ে বাসায় চলে গেছে। আরও কিছু শিক্ষার্থীরা বর্তমানে হাসপাতালে আছে। তাদেরকেও দেখাশোনা করা হচ্ছে। আমরা অনেক জায়গা থেকে আর্থিক সহযোগিতা নিয়ে তাদেরকে দিয়েছি। কিছু শিক্ষার্থীরা চিকিৎসা নিয়ে বাসায় গেলেও তাদের আঘাতপ্রাপ্ত স্থানে ইনফেকশন দেখা দিয়েছে। তাদেরকে আবার হাসপাতালে ভর্তি করানো হবে বলেও জানান তিনি।
শাহিনুল আশিক/আরকে