লক্ষ্মীপুরে আওয়ামী লীগের সাবেক ৪ এমপির খোঁজ নেই, নেতারা উধাও
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশে ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে লক্ষ্মীপুরে ৪টি আসনের সদ্য সাবেক এমপিদের খোঁজ মিলছে না। তারা কোথায় আছেন কেউ জানেন না। ধারণা করা হচ্ছে তারা আত্মগোপনে রয়েছেন। এছাড়া আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগসহ অঙ্গসংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের পদধারীরাও পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
গতকাল বুধবার বিকেলে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও লক্ষ্মীপুর-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক পিংকু, সাধারণ সম্পাদক ও লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য নুরউদ্দিন চৌধুরী নয়ন, রামগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও লক্ষ্মীপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আনোয়ার হোসেন খান এবং জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও লক্ষ্মীপুর-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আবদুল্লাহ আল মামুনের মোবাইল ফোনে কল দিয়ে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
জানা গেছে, ছাত্র আন্দোলনকে ঘিরে ৪ আগস্ট দুপুর ১২টার দিকে লক্ষ্মীপুরের মাদাম ব্রিজ-ঝুমুর এলাকায় শিক্ষার্থী-জনতা অবস্থান নেয়। সেখানে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ-ছাত্রলীগসহ অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা আন্দোলনকারীদের ধাওয়াসহ গুলি করে। এতে উভয়পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। আওয়ামী লীগের লোকজনের গুলিতে ঘটনাস্থলে গুলিবিদ্ধ হন শিক্ষার্থী আফনান পাটওয়ারী। সেখানে আওয়ামী লীগ ও আন্দোলনকারীদের বেশ কয়েকজন আহত হন।
পরে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে টিকতে না পেরে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা পিছু হটতে শুরু করে। শিক্ষার্থীরা ঝুমুর-মাদাম ব্রিজ থেকে উত্তর তেমুহনীর দিকে পা বাড়ায়। পথে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা জাকির হোসেন ভূঁইয়া আজাদদের মালিকানাধীন রোজগার্ডেনের ভবনে ভাঙচুর করা হয়। পরে উত্তর তেমুহনী এলাকায় আসে অবস্থান নেওয়া আওয়ামী লীগ আন্দোলনকারীদের দেখে পালিয়ে যায়।
এতে আন্দোলনকারীরা উত্তর তেমুহনী এলাকায় এসে আওয়ামী লীগের অবস্থান কর্মসূচির জন্য রাখা প্লাস্টিকের চেয়ারগুলো ভেঙে ফেলেন। বিভিন্ন স্থানে থাকা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ব্যানার-ফেস্টুন ভেঙে ও ছিঁড়ে আগুন লাগিয়ে দেন। উত্তর তেমুহনী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানে ম্যুরালও ভেঙে দেওয়া হয়। পরে আওয়ামী লীগের এমপি নয়ন, জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি চৌধুরী মাহমুদুন্নবী সোহেলের বাসা ভাঙচুর ও আগুন লাগিয়ে দেয় আন্দোলনকারীরা।
এরপর আন্দোলনকারীরা পা বাড়ায় বাজারের দিকে। এরমধ্যে তিতাখাঁ মসজিদ এলাকায় গেলে হঠাৎ গুলিতে থমকে যায় আন্দোলনকারীরা। তমিজ মার্কেট এলাকায় সাবেক পৌর মেয়র প্রয়াত আবু তাহেরের বাসার ছাদ থেকে তার মেঝো ছেলে সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি একেএম সালাহ উদ্দিন টিপু আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ছেন। অভিযোগ রয়েছে মাদাম ব্রিজ এলাকাতেও তিনি আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি করেন। বাসার ছাদ থেকে টিপু ও তার সঙ্গে থাকা লোকজন প্রায় ৩ ঘণ্টা আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালায়। তবে দমে যাননি আন্দোলনকারীরা।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, অনবরত গুলি থেকে বাঁচার জন্য বিভিন্ন ধরণের কৌশল অবলম্বন করেছেন শিক্ষার্থীরা। এক পা এক পা করে তারা বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে টিপুর বাসার সামনে যান। এরমধ্যে ধারণা করা হচ্ছে টিপুসহ তার লোকজনের কাছে আর কোনও গুলি ছিল না। শেষ হয়ে যেতেই সামনে এগিয়ে যান আন্দোলনকারীরা। পরে আন্দোলনকারীরা বাজার সড়কের দুপাশে টিপুদের দুটি বাসভবনে ভাঙচুরসহ আগুন লাগিয়ে দেয়। রাত ২টার পর্যন্ত আগুন জ্বলে দুটি ভবনে। এরমধ্যে গুলিতে ৩ জন শিক্ষার্থী মারা যান। ঢাকায় নেওয়ার পথে মাদাম ব্রিজ এলাকায় গুলিবিদ্ধ আফনান মারা যান।
আফনান লক্ষ্মীপুরের আন্দোলনে প্রথম শহীদ। ওই ঘটনায় টিপুর বাসা থেকে নারী ও শিশুদের বের করে আন্দোলনকারীরা নিরাপদে সরিয়ে দেয়। টিপুসহ যুবলীগ-ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের কয়েকজন নেতাকর্মী বাসায় থাকলেও পরে আর তাদের কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি। তবে টিপুর সঙ্গে থাকা এক ইউপি সদস্যসহ যুবলীগ-ছাত্রলীগের ৭ জন গণপিটুনিতে মারা যান। বিকেল থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত এ ৭ জনের মৃত্যু হয়। তবে তাদের মরদেহ ভোররাত পর্যন্ত রাস্তায় পড়ে ছিল। যুবলীগ নেতা টিপুসহ তার সঙ্গে থাকা অন্যরা কোথায় আছে তা কেউই বলতে পারেনি। তবে ভবনটি থেকে ২৫ জনকে জীবিত উদ্ধার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
এদিকে পরদিন শেখ হাসিনার দেশত্যাগের খবরে শহরে বিজয় মিছিল করে শিক্ষার্থী-জনতাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। এইদিন ফের টিপু, এমপি নয়ন ও ছাত্রলীগ নেতা সোহেলের বাসায় আগুন দেওয়া হয়। ভাঙচুর-আগুন থেকে বাদ যায়নি লক্ষ্মীপুর পৌরসভার মেয়র মোজাম্মেল হায়দার মাসুম ভূঁইয়া ও জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক রাকিব হোসেন লোটাসের বাসা। এরপর থেকেই লক্ষ্মীপুরে আওয়ামী লীগের পদধারী কাউকে দেখা যায়নি।
আন্দোলনকে ঘিরে রায়পুর ও রামগঞ্জ থানা-উপজেলা কার্যালয়ে ভাঙচুর-আগুন দেওয়া হয়। অস্ত্র লুটপাটের ঘটনাও ঘটেছে বলে জানা গেছে। জীবন রক্ষায় রায়পুর থানার পুলিশ সদস্যরা পালিয়ে যান। বিষয়টি জানতে দুটি থানার ওসিকে কল দিয়েও কথা বলা সম্ভব হয়নি।
নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের ৫ জন সিনিয়র নেতা জানান, শেখ হাসিনা ছিলেন আওয়ামী লীগের কর্মীদের ভরসা। কিন্তু তিনি এভাবে চলে যাবেন বিশ্বাস করতে পারছি না। জেলা-উপজেলা সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকরাও আত্মগোপনে রয়েছেন। তারা কারও খোঁজ নিচ্ছেন না।
জেলা শ্রমিক লীগের আহ্বায়ক ও সদর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ইউছুফ পাটওয়ারী বলেন, আমি নিরাপদে আছি। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি-সম্পাদকের কারও সঙ্গে কোনও যোগাযোগ নেই। একবারের জন্যও তারা খোঁজ নেয়নি। আমি কখনো কারো ক্ষতি করিনি।
চন্দ্রগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল ওহাব বলেন, শারিরীকভাবে অসুস্থ। তবে নিরাপদে আছি। আমাদের থানা সভাপতি কাশেম চৌধুরী ভালো আছেন। জেলা সভাপতি পিংকু ঢাকায় আছেন।
রামগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ইমতিয়াজ আরাফাত বলেন, আমি ভালো আছি। আমার বাবা (জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. শাহজাহান) ভালো আছেন। আমরা নিরাপদেই আছি।
সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসক (ডিসি) সুরাইয়া জাহান বলেন, লক্ষ্মীপুরের সাবেক ৪ এমপির কোনও খোঁজ খবর আমার জানা নেই। জেলায় নিরাপত্তা ব্যবস্থায় সেনাবাহিনী মাঠে রয়েছেন। শিক্ষার্থীরাও শহর পরিষ্কার, সড়কে যান চলাচলে কাজ করছেন।
হাসান মাহমুদ শাকিল/এমএসএ