কুষ্টিয়ায় সংঘাতে দুই দিনে ৯ জনের মৃত্যু
কুষ্টিয়ায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘিরে সংঘাতে দুই দিনে ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। সোমবার (৫ আগস্ট) বিকেলের দিকে থানাপাড়ায় ও মজমপুর এলাকায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে সাতজন নিহত হন। এ ছাড়া সংঘাত-সহিংসতায় অজ্ঞাত আরও দুইজনের মৃত্যু হয়েছে।
কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক রফিকুল ইসলাম সব মিলিয়ে ৯ জন নিহতের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘিরে ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের অধিকাংশই গুলিতে নিহত। কুপিয়ে হত্যার লাশও আছে। এসব ঘটনায় দুই শতাধিক মানুষ আহত হয়।
নিহতরা হলেন-কুষ্টিয়া সদর উপজেলার হরিপুর এলাকার বাবু (৩৫), একই এলাকার আশরাফুল ইসলাম (৩২), কুষ্টিয়া শহরের থানাপাড়া এলাকার লোকমানের ছেলে আবদুল্লাহ (১৬), বড়বাজার এলাকার সবুজ, কুষ্টিয়া সদর হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংকের সাবেক কর্মচারী ইউসুফ (৫০), দহকুলা এলাকার ওসামা, ভেড়ামারার জিয়া, বাকি দুইজন অজ্ঞাত।
জানা গেছে, সোমবার সকাল থেকেই শহরের বিভিন্ন জায়গায় আন্দোলনকারী ও পুলিশের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পুলিশ আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদানে গ্যাস, রাবার বুলেট নিক্ষেপ ও গুলি করে। কুষ্টিয়া শহরের থানার মোড়, মজমপুর, সাদ্দাম বাজার, এনএস রোড়, ছয় রাস্তার মোড়, পাঁচ রাস্তার মোড়সহ বিভিন্ন এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এ সময় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীসহ আটজন নিহত হন। আহত হন অন্তত দুই শতাধিক মানুষ। পরে পরিস্থিতি সামাল দিতে না পেরে থানা ত্যাগ করেন পুলিশ সদস্যরা।
এতে ক্ষিপ্ত হয়ে আন্দোলনকারীরা ও বিক্ষুব্ধ জনতা থানায় হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেন। এ সময় থানার ভেতর থেকে যে যা পারছে নিয়ে গেছে। অনেকে পুড়ে যাওয়া গাড়ি, গাড়ির যন্ত্রপাতি, অস্ত্র, আসবাবপত্র, মোটরসাইকেল ইত্যাদি জিনিসপত্র নিয়ে গেছে।
এদিকে শেখ হাসিনার পদত্যাগ করে দেশত্যাগের খবরে মাহবুবউল আলম হানিফ ও কামারুল আরেফিনের বিলাসবহুল বাসভবনে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছে আন্দোলনকারী বিক্ষুব্ধ জনতা। সোমবার ও মঙ্গলবার দফায় দফায় এ ঘটনা ঘটে। এ সময় সেখানে থাকা জিনিসপত্র নিয়ে গেছে দুর্বৃত্তরা। এ ছাড়া জেলা ও থানা পর্যায়ে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কার্যালয়, আওয়ামী লীগের বিভিন্ন নেতাকর্মীর বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়। এ ছাড়াও কুষ্টিয়া মডেল থানা, ওসির বাসভবন, ভাস্কর্য, ট্র্যাফিক অফিস, টোলপ্লাজাসহ বিভিন্ন জায়গায় ভাঙচুরসহ অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে।
এদিকে বিএনপি, জামায়াতসহ সমমনা বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীদের সরব উপস্থিতির পরও থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে কুষ্টিয়ায়। আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের বেশির ভাগ নেতা আত্মগোপনে চলে গেছেন। এর আগে গত সোমবার রাতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংঘর্ষে প্রাণ হারান সবুজ নামের এক বিএনপি কর্মী।
স্থানীয় বাসিন্দা ও বিক্ষুব্ধ জনতা বলেন, কুষ্টিয়া-৩ (সদর) আসনে তিনবারের সাবেক সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ ও কুষ্টিয়া-২ (মিরপুর-ভেড়ামারা) আসনের সাবেক এমপি কামারুল আরেফিন অনিয়ম দুর্নীতির ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। দেশ-বিদেশে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। তারা দুজন মিলে কুষ্টিয়ায় টেন্ডারবাজি, মাদক ব্যবসায়, অবৈধভাবে পদ্মা-গড়াইয়ের বালু উত্তোলন ও চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করত। অসংখ্য মানুষকে নির্যাতন-নিপীড়ন করেছেন সন্ত্রাসী বাহিনীর এই গডফাদাররা। আমরা তাদের বিচার চাই। তাদের সব অপরাধের সুষ্ঠু তদন্ত করা হোক। আমরা তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি। তাদের অত্যাচারে অসংখ্য মানুষ ঘরছাড়া, অনেক মানুষ শান্তিতে ঘুমাতে পারেনি। তাই দীর্ঘ ১৫ বছরের ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে বিক্ষুব্ধ জনতা
সোমবার দিনব্যাপী ও মঙ্গলবার পর্যন্ত কুষ্টিয়া সদরসহ জেলার বিভিন্ন জায়গায় এই সহিংসতার চিত্র দেখা গেছে। সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর দেশত্যাগের খবরে কুষ্টিয়া শহরের বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষুব্ধ জনতার ঢল নামে। আনন্দ উল্লাসে ফেটে পড়া জনতা এ সময় কুষ্টিয়া মডেল থানা, শহরের পিটিআই রোডের হানিফের বাড়ির মালামাল নেওয়া শুরু করে দুর্বৃত্তরা। বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত সময়ে তারা ফ্রিজ, সোফা, এসি, আসবাবপত্রসহ বিভিন্ন মালামাল নিতে থাকে। এ সময় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। একইভাবে কুষ্টিয়া মডেল থানা থেকে অস্ত্র, মোটরসাইকেল, গাড়ির বিভিন্ন যন্ত্রপাতি, ফ্রিজ, সোফা, এসি, আসবাবপত্রসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র নিতে দেখা যায় দুর্বৃত্তদের। এ ছাড়া মিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক কামারুল আরেফিন কুষ্টিয়া-২ (মিরপুর-ভেড়ামারা) আসনে এমপির মিরপুরের বাসভবনে ও হানিফ এমপির ভাই কুষ্টিয়া সদর উপজেলার চেয়ারম্যান আতাউর রহমান আতার বাসভবনে ভাঙচুরসহ অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করা হয়।
এদিকে পুলিশ কোনো দায়িত্ব পালন না করায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে ট্র্যাফিক নিয়ন্ত্রণ করতে দেখা গেছে। তারা শহরের গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে মোড়ে ও সড়কে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজও করেন। তারা বলেন, দেশটা আমাদের। আমাদেরই গড়তে হবে। তাই গত কয়েক দিনের আবর্জনা পরিষ্কার করা হচ্ছে। আর ট্র্যাফিক পুলিশ না থাকায় যান চলাচল নিয়ন্ত্রণে বাঁশি বাজিয়ে ট্র্যাফিকের কাজও অব্যাহত থাকবে। পাশাপাশি সনাতন সম্প্রদায়ের মন্দিরগুলোতে রাতে পাহারা বসানো হয়েছে।
এ বিষয়ে কুষ্টিয়া মডেল থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহফুজুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, থানায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এ সময় অস্ত্র, গাড়িসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র লুটপাট করা হয়। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে কুষ্টিয়া মডেল থানা। পুরো থানা আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কোনো কিছু আর অবশিষ্ট নেই। তবে কী পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুট হয়েছে, তা তাৎক্ষণিকভাবে জানাতে পারেননি তিনি।
২৫০ শয্যা কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) তাপস কুমার সরকারের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করলেও তারা রিসিভ করেননি।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য কুষ্টিয়ার চার এমপি, জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে তাদের পাওয়া যায়নি। তারা আত্মগোপনে রয়েছে বলে জানা গেছে।
রাজু আহমেদ/এএমকে