‘ছাত্র বলার পরও পুলিশ আমাকে ছেড়ে দেয়নি’
‘আমি জ্ঞান ফিরে দেখি, আমার হাতে হ্যান্ডকাপ। আমি পুলিশ লাইন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্র, সে কথাও তাদের (পুলিশকে) বলেছিলাম। তারপরও তারা আমাকে ছেড়ে দেয়নি।’
কারাগার থেকে বেরিয়ে অশ্রুসজল চোখে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন জামিনে মুক্ত হওয়া ১৬ বছর ১০ মাস বয়সী কিশোর আলফি শাহরিয়ার মাহিম। কোটা সংস্কার আন্দোলনে গুলিতে নিহত বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ হত্যা মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠিয়েছিল পুলিশ।
কারাগারে ১৩ দিন থাকার পর বৃহস্পতিবার (১ আগস্ট) বিকেল ৫টা ১৮ মিনিটে মুক্তি পায় আলফি শাহরিয়ার মাহিম। এর আগে দুপুর ১টার দিকে রংপুর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১ আদালতের বিচারক মোস্তফা কামাল তাকে জামিনের আদেশ দেন। নথিপত্র অনুযায়ী শিক্ষার্থী মাহিমের বয়স ১৬ বছর ১০ মাস হওয়ায় এবং অপরাধের সাথে জড়িত না থাকার তথ্য প্রমাণ পাওয়ায় উভয় পক্ষের শুনানি শেষে ১০০ টাকার বন্ডে জামিন আদেশ দেওয়া হয়। কিশোরের আইনজীবী আবদুল মোকছেদ বাহালুল এসব তথ্য নিশ্চিত করেন।
রংপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার প্রশান্ত কুমার বনিক বলেন, আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী তাকে কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। এর আগে বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে আদালত থেকে জামিনের আদেশ নিয়ে কারাগার কর্তৃপক্ষের কাছে দেওয়া হয়।
এদিকে বিকেলে কারাগারের প্রধান ফটক থেকে বেরিয়ে মাহিম তার বাবার হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে সড়কের ওপরে আসেন। কারাগার থেকে বের হওয়ার সময় ওই কিশোরকে খুবই বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। প্রধান সড়কের আসার সঙ্গে সঙ্গে তাকে কাছে পেয়ে জড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন মা, বোনসহ স্বজনেরা। এতে হৃদয়বিদারক এক দৃশ্যের অবতারণা হয়। এ সময় সড়কের পাশে গণমাধ্যমকর্মীরাসহ উৎসুক জনতা ভিড় করেন।
কারাগারের সামনে প্রধান সড়কের ওপর ছিলেন তার বাবা মোহাম্মদ শাহজালাল, মা আঞ্জুমান আরা ময়না, খালা আয়শা সিদ্দিকা, বড় আম্মা রোশনা, বোন সানজানা ইসলাম স্নেহাসহ পরিবারের অন্যান্য স্বজন এবং আইনজীবীরা।
গণমাধ্যমকর্মীরা ছররা গুলি কোথায় লেগেছে, জানতে চাইলে শার্টের বোতাম খুলে বুকের মধ্যে ক্ষতচিহ্ন দেখায় ওই কিশোর। ওই দিনের ঘটনা জানিয়ে কিশোর মাহিম বলে, ‘পুলিশ যখন টিয়ারশেল ছেড়েছিল আমি তখন অচেতন অবস্থায় পড়েছিলাম। আমার পেছন থেকে সবাই চলে যায়। গুলিটা আমার গলায় লেগেছিল। মনে হলো কিছু একটা শরীরে বিঁধল। দুই সপ্তাহ আগের ঘটনা, ক্ষতস্থানটা এখন হয়তো সেভাবে দেখা যাচ্ছে না। ঘটনার সময় আমার সঙ্গে কলেজ ব্যাগ ছিল। কলেজ ড্রেস, আইডি কার্ড সবকিছু তাজহাট থানা পুলিশের কাছে ছিল। পরে তো শুনছি তাজহাট থানা নাকি পুড়িয়ে দিয়েছে।’
ছেলের চিকিৎসার বিষয়ে মাহিমের বাবা মোহাম্মদ শাহজালাল বলেন, ‘ছেলেকে নিয়ে এখন বাসায় যাই, খাওয়া-দাওয়া ও গোসল করুক, বিশ্রাম নিক। এরপর সব বুঝেশুনে প্রয়োজন হলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার ছেলে নির্দোষ, আমি এই মামলা থেকে তার অব্যাহতি চাই। মামলা থেকে অব্যাহতির বিষয়ে আমরা পুলিশ কমিশনার স্যারের কাছে গিয়েছিলাম, তিনিও আমাদের আশ্বস্ত করেছেন। আশা করছি আমার ছেলে আমার হয়রানির শিকার হবে না।’ এরপর একটি অটোরিকশায় ছেলেকে নিয়ে স্বজনেরা বাড়ির উদ্দেশে চলে যান।
এর আগে পুলিশের কাজে বাধা দেওয়া ও আবু সাঈদ হত্যা মামলায় গত ১৯ জুলাই পুলিশ লাইন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী আলফি শাহরিয়ার মাহিমকে কারাগারে পাঠান আদালত। মাহিম গত বছর রংপুর নগরীর আশরতপুর চকবাজার এলাকার সিদ্দিক মেমোরিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি পাস করে। তার বাবা মোহাম্মদ শাহজালাল চকবাজার এলাকার বাসিন্দা ও পেশায় একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী।
পুলিশ জানায়, কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গত ১৬, ১৮ ও ১৯ জুলাই সংঘাত-সংঘর্ষ পরিস্থিতিতে ওই শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার পরবর্তী যাছাই-বাছাই করার সুযোগ না থাকায় এমন ঘটনা ঘটেছে। বিষয়টি তারা অবগত হয়েছেন। তাকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হবে।
রংপুর মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার (অপরাধ) আবু মারুফ হোসেন বলেন, ১৮ জুলাই যখন থানায় হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট হয়, তখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হয় মাহিম। পরে তাকে পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়। যেহেতু ১৮ ও ১৯ জুলাই সংঘাত-সংঘর্ষ নিয়ে পুরো বাহিনী ব্যস্ত ছিল, সে কারণে বিষয়টি যাছাই-বাচাই করা সম্ভব হয়নি। মূলত ২০ জুলাই থেকে আমরা যাছাই-বাচাই সাপেক্ষে গ্রেপ্তার করছি।
তিনি আরও জানান, বিষয়টি পুলিশ কমিশনার অবগত হওয়ার পরই সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, মাহিম আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল মাত্র, ওই ঘটনায় জড়িত ছিল না। জামিনের মাধ্যমে তাকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হবে।
প্রসঙ্গত, কোটা সংস্কার আন্দোলনে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম সমন্বয়ক ছিলেন আবু সাঈদ। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী। মা-বাবার ৯ সন্তানের মধ্যে একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া সন্তান ছিল আবু সাঈদ। গত ১৬ জুলাই বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন পার্ক মোড়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগ-যুবলীগের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ সময় মিছিলের সম্মুখে থেকে বুক পেতে দেওয়া আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে নিহত হন। এ ঘটনার পর আন্দোলনের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে রংপুরসহ পুরো দেশজুড়ে।
এ ঘটনার পরদিন ১৭ জুলাই এসআই বিভূতি ভূষণ রায় বাদী হয়ে রংপুরের তাজহাট থানায় মামলা করেন। সেই মামলায় মাহিমকে গ্রেপ্তার দেখায় পুলিশ। বুধবার (৩১ জুলাই) ভুক্তভোগীর বোন সানজানা আখতার স্নেহা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিলে বিষয়টি আলোচনায় আসে। এরপরই কিশোর শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার ও কারাগারে পাঠানোর ঘটনায় নড়েচড়ে বসে প্রশাসন।
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/আরএআর