পুলিশি হেফাজত থেকে ববির ১২ শিক্ষার্থীকে ছাড়িয়ে আনলেন শিক্ষকরা
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অংশ ‘রিমেমবারিং আওয়ার হিরোজ’ কর্মসূচি শুরুর আগেই ছাত্রলীগের সহায়তায় সমন্বয়কসহ ১২ জনকে পুলিশ তুলে নিয়ে যায় বলে অভিযোগ করেছেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ববি) শিক্ষার্থীরা। বৃহস্পতিবার (১ আগস্ট) বেলা ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকে এ ঘটনা ঘটে।
৫ ঘণ্টা থানায় আটকে রাখার পরে বিকেল ৪টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আটকদের মুক্ত করে আনেন। শিক্ষার্থী আটকে রাখার এই ৫ ঘণ্টায় নগরীর বন্দর থানার মূল ফটক তালাবন্ধ করে রাখা হয়। শিক্ষার্থীদের অভিভাবক, আইনজীবী ও সাংবাদিক কাউকেই ভেতরে প্রবেশে করতে দেওয়া হয়নি।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক সুজয় শুভ বলেন, আজকে ছাত্র-শিক্ষকদের যৌথ সংহতি সমাবেশ ছিল। আমরা ক্যাম্পাসের গেটে এসে দেখি ছাত্রলীগ ও পুলিশ যৌথভাবে টহল দিচ্ছে। তারা আমাদের ধরে ধরে পুলিশের ভ্যানে তুলে দিয়েছে। এমনকি নারী আন্দোলনকর্মীদেরও পুরুষ পুলিশ সদস্যরা একইভাবে আটক করেছে।
তিনি বলেন, আমাদেরকে থানায় নিয়ে আসার পরে শিক্ষকরা আমাদের ছাড়াতে ছুটে আসলে পুলিশ তাদের সঙ্গে খুবই বাজে ও ন্যাক্কারজনক আচরণ করেন।
আরেক আন্দোলনকারী দাবি করেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আব্দুল কাইউমের নেতৃত্বে আমাদের আটক করা হয়েছে। তিনি শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমন করার জন্য নানা কৌশল ব্যবহার করছেন। ক্যাম্পাসে যেন কোনো শিক্ষার্থী প্রবেশ না করতে পারেন এজন্য ছাত্রলীগ নিয়ে তিনি টহল দেন। আজকে আমাদের আটকের খবর শুনে অন্যন্য শিক্ষকরা যখন ছুটে এসেছেন, তিনি বাধ্য হয়ে এসেছেন।
আটক আন্দোলনকারী ভূমিকা সরকার বলেন, আমাদের তুলে এনে থানায় আটকে রেখেছে। আমরা যেন আমাদের অধিকারের কথা বলতে না পারি সেজন্য পুলিশ আক্রমনাত্মক ভূমিকা নিয়েছে। এভাবে আমাদের থামানো যাবে না। লাশের ওপর দাঁড়িয়ে আমাদের আন্দোলন কোনো কৌশলেই দমিয়ে রাখা যাবে না।
যা বলছেন ছাত্রলীগের কর্মীরা
বৈষম্যবিরোধী অন্দোলনকারীরা যেন বিশ্ববিদ্যালয়ে জড়ো হতে না পারে সেজন্য সকাল থেকেই ছাত্রলীগের কর্মীরা ক্যাম্পাস এলাকায় অবস্থান নেন। ছাত্রলীগের নেতৃত্ব দেওয়া অমিত হাসান রক্তিম বলেন, শোকের মাস আগস্টে কেউ যেন নৈরাজ্য করতে না পারে সেজন্য আমরা অবস্থান নিয়েছি। আদালত যে রায় দিয়েছে এবং সরকারের প্রজ্ঞাপন সাধারণ ছাত্রসমাজ মেনে নিয়েছে। এর বাইরে আন্দোলনের নামে যারা নৈরাজ্য-সহিংসতা করতে চায় তাদের নিজস্ব এজেন্ডা আছে। এজেন্ডা বাস্তবায়নে কেউ এলে আমরা তাদের প্রতিহত করবো।
আরেক কর্মী রিয়াজ মোল্লা বলেন, জামায়াত-বিএনপি পরিবারের কিছু শিক্ষার্থী সাধারণ ছাত্রদের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সরকারের বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার-গুজব ছড়াচ্ছে। সাধারণ ছাত্রদের সাথে নিয়ে আন্দোলনের নামে অপপ্রচারকারীদের প্রতিহত করতে আমাদের এই অবস্থান।
এ সময়ে অর্ধশত ছাত্রলীগ কর্মীকে ক্যাম্পাসে টহল ও জড়ো হয়ে মিছিল করতে দেখা গেছে।
থানার গেটে তালা
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের গাড়িতে তুলে নিয়ে নগরীর বন্দর থানায় আটকে রাখা হয়। শিক্ষার্থীদের আটকের খবর পেয়ে কয়েকজন আইনজীবী, বামগণতান্ত্রিক জোটের নেতৃবৃন্দ ও শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা থানায় যান। কিন্তু প্রধান ফটক আটকে দেওয়ায় তারা প্রবেশ করতে পারেননি।
বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী আবু আল রায়হান বলেন, কোনো কারণ ছাড়াই শিক্ষার্থীদের আটক করে থানায় নিয়ে আসা হয়েছে। কী কারণে থানায় নিয়ে আসা হয়েছে তা জানতে আমি এসেছি, শিক্ষার্থীদের অভিভাবক ও কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ এখানে এসেছেন। কিন্তু ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমরা থানার গেটে অপেক্ষা করেছি। পুলিশ আমাদের ভেতরে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না। দেশ আমার, থানা আমাদের। তাহলে কেন ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না? শিক্ষার্থীদের কী কারণে আটক করা হয়েছে সেই কারণ জানতে চাইলেও পুলিশ সদস্যরা উত্তর দিতে বাধ্য না বলে জানান।
এই আইনজীবী বলেন, থানার ওসি জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর তাকে বলেছেন ছাত্রদের পক্ষে যেন কেউ থানায় ঢুকতে না পারেন এবং ছাত্রদের যেন কেউ ছাড়িয়ে নিতে না পারেন। প্রক্টরের নির্দেশেই পুলিশ থানায় কাউকে ঢুকতে দেয়নি। শিক্ষার্থীরা আটক হয়েছে প্রক্টরের নির্দেশে এবং তিনি এসে ছাড়িয়ে নিয়ে নিজে হিরো সাজবেন। এসব নোংরামি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর যদি বন্ধ না করেন, থানার গেট আটকে দেওয়ার মতোর স্বৈরাচারী আচরণ যদি বন্ধ না হয় তাহলে আন্দোলন থামবে না।
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল বরিশাল জেলা শাখার সমন্বয়ক ডা. মনীষা চক্রবর্তী বলেন, থানা জনগণের জন্য উন্মুক্ত থাকার কথা থাকলেও আমরা বন্দর থানার গেটে এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করছি। পুলিশ আমাদের ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়নি। পুলিশ জনগণকে ভয় পেতে শুরু করেছে। সাধারণ জনগণকেও তারা থানায় ঢুকতে দিচ্ছে না। এটা সরকারের জনবিরোধী একটি আচরণ। আমি বলতে চাই, অবিলম্বে ছাত্রদের ৯ দফা দাবি সরকারকে মেনে নিতে হবে। দাবি মেনে নেওয়া ছাড়া কোনো ভয় দেখানো, খুন, গুম সাধারণ ছাত্র-জনতাকে পিছু হটাতে পারবে না।
তবে ওসির সাথে কথা বলার জন্য গণমাধ্যমকর্মীরা প্রবেশের চেষ্টা করলে তাদেরও আটকে দেওয়া হয়।
যা বলছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের আটকের ঘটনায় থানায় ছুটে যান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আব্দুল কাইউম, শিক্ষক সমিতির সভাপতি আব্দুল বাতেন, বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান উন্মেষ রয়, জীবনানন্দ রিসার্চ সেন্টারের চেয়ারম্যান সঞ্জয় সরকার, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রক্টর ড. খুরশিদ আলমসহ বেশ কয়েকজন শিক্ষক।
ড. খুরশিদ আলম বলেন, আমরা জানতে পেরছি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২ জন শিক্ষার্থীকে পুলিশ হেফাজতে নিয়েছে। আমরা জানতে এসেছি কেন তাদের থানায় আনা হয়েছে জানতে। থানার গেট আটকানো ছিল। আমরা আসার পরে আমাদের ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়।
বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান উন্মেষ রয় বলেন, শিক্ষার্থীদের ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য আমরা থানায় যাই। সেখানে পুলিশের ওসিসহ কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে শিক্ষার্থীদের ছাড়িয়ে আনা হয়েছে।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি আব্দুল বাতেন বলেন, সারাদেশে শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষ নিহতের ঘটনায় আমরা বিবৃতি দিয়েছি। আমাদের অবস্থান স্পষ্ট। আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থীদরে ওপর যে হামলা হয়েছে তার সুষ্ঠু তদন্ত ও যথাযথ বিচার দাবি করছি।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আব্দুল কাইউম বলেন, পুলিশ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে আটক করে থানায় নিয়ে এসেছে জেনে আমরা থানায় এসেছি। শিক্ষার্থী আটক করানো ও ছাড়িয়ে নেওয়ার বিষয়ে আমার বিরুদ্ধে যে কথা বলা হচ্ছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট। একজন শিক্ষক হিসেবে কেন আমি শিক্ষার্থীদের আটক করাবো- প্রশ্ন তোলেন তিনি।
শিক্ষকবৃন্দ বিকেল ৪টার দিকে হেফাজতে থাকা শিক্ষার্থীদের নিয়ে থানা থেকে বের হন। শিক্ষার্থীরা থানার গেট পার হওয়ার পরপরই বৈষম্যবিরোধী মিছিল শুরু করেন।
যা বললেন ওসি
বরিশাল মহানগর পুলিশের বন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুর রহমান মুকুল বলেন, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের একটি কর্মসূচি থাকায় তারা ক্যাম্পাসের সামনে জড়ো হয়েছিল। কারফিউ চলায় কোনো সভা-সমাবেশ করা নিষিদ্ধ। আন্দোলনকারীদের ওপর যেন কোনো আক্রমণ না হয় সেজন্য ১২ জনকে হেফাজতে নেওয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের জিম্মায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, থানায় গণমাধ্যমকর্মী প্রবেশে কোনো নিষেধ নেই। তবে তখন থানায় লোকজন বেশি ছিল বিধায় সবার নিরাপত্তার স্বার্থেই এমনটা করা হয়েছে। এই যে এখন ঢুকলেন।
সৈয়দ মেহেদী হাসান/আরএআর