‘আমার নাতি আমাকে জিজ্ঞেস করে, বাবা কোথায়?’
কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় গত ২০ জুলাই গাজীপুরের বোর্ড বাজার এলাকায় মো. আরিফ হোসেন রাজিব (২৬) নামের এক যুবক ভাঙারি দোকানে যাওয়ার সময় গুলিবিদ্ধ হন। পরে তাকে গাজীপুর সদর মেডিকেলে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
বুধবার (৩১ জুলাই) বিকেলে ঢাকা পোস্টকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার গজরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শহীদ উল্লাহ।
নিহত রাজিবের গ্রামের বাড়ি গজরা ইউনিয়নের টরকী এওয়াজ গ্রামে। রজ্জব প্রধান ও রহিমা বেগম ভিক্ষুক দম্পতির বড় ছেলে রাজিব। পরিবারে দুই ভাই এবং চার বোনের মধ্যে তিন বোন বিবাহিত। রাজিবের স্ত্রী ও ইব্রাহিম নামে তিন বছর বয়সী একটি ছেলে সন্তান রয়েছে। রাজীব পরিবার নিয়ে গাজীপুর বোর্ড বাজার এলাকায় বসবাস করতেন। সেখানে ভাঙারি ক্রয় করে বিক্রয় করতেন তিনি।
স্থায়ীরা জানান, গাজীপুর বোর্ড বাজার এলাকায় গত ২০ জুলাই (শনিবার) কোটা সংস্কার আন্দোলনে পুলিশ-শিক্ষার্থীদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষ চলছিল। ওই সময় রাজিব ভাঙারির দোকানে যাওয়ার সময় গুলিবিদ্ধ হন। পরে তাকে গাজীপুর সদর মেডিকেলে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ২১ জুলাই তাকে রাঢ়ীকান্দি কবরস্থানে দাফন করা হয়।
নিহত রাজিবের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, ছোট্ট একটি ঝুপড়ি বসতঘর তাদের। পাশেই রয়েছে পলিথিন ও কাপড়ের প্যাঁচানো রান্নাঘর। তার ছোট বোন রান্না করছেন। স্ত্রী শরিফা বেগম শিশু ছেলেকে ঘুম পাড়াচ্ছেন আর কান্না করছেন। এমন সময় হঠাৎ শোনা গেল রাজিবের মা রহিমা বেগমের কান্নার আওয়াজ। ছেলের মৃত্যুতে এখন প্রায় পাগল হয়ে গেছেন এই মা। ছেলেকে নিয়ে নানাভাবে আহজারি করতে দেখা গেছে।
নিহত রাজিবের মা রহিমা বেগম কাউকে দেখলেই বলেন, ‘ও বাবা কে আমাকে মা বলে ডাকবে, তোমরা আমাকেও মাটি দিবা?, ও বাবা তোমরা আমাকেও মাটি দাও। আমার বাবাকে আল্লাহ জান্নাতবাসী করুক। আল্লাহ তাকে বেহেস্ত নসিব করুক। আমি তো জানি না সেদিন কি হয়েছিল, আমি থাকলে তাকে বের হতে দিতাম না। তাকে বুকের ভেতর জড়িয়ে রাখতাম। আমার স্বামীতো ভিক্ষা করে খায়, ছেলের মৃত্যুর পর সে আজ এগারো দিন ভিক্ষা করতে পারে না। আমার পাতিলে ভাত নাই। এখন আমাকে কে দেখবে? আমাকে তোমরা কেউ আমার ছেলের কাছে নিয়ে যাও। আমি তার সঙ্গে ঘুমাব। আমার স্বামীর কোনো অর্থ-সম্পদ নাই। আমি এখন কই যাব। আমি ছেলে হত্যার বিচার চাই।’
তিন বছরের নাতিকে কোলে নিয়ে আহজারি করে তিনি বলেন, ‘আমার এই পরান পাখিরে আমি কেমনে বাঁচাবো? আমার কোনো অর্থ-সম্পদ নাই। আমার নাতি আমাকে জিজ্ঞেস করে, বাবা কোথায়? আমি তাকে বলি, সে গাড়ি চালাতে গেছে।’
আরিফ হোসেনের স্ত্রী শরিফা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার জীবনের প্রদীপ মনে হয় নিভে গেল। আমি এখন অন্ধকারে পড়ে গেলাম। আমার স্বামী (আরিফ) দোকানে যাওয়ার কথা বলে ২০ জুলাই বিকেল ৩টার দিকে বাসা থেকে বের হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরেই জানতে পারি আরিফ গুলি খেয়ে আহত হয়েছে। তার পেটের মধ্যে গুলি করা হয়েছে। পরে তাকে হাসপাতাল নিয়ে যাই।
তিনি আরও বলেন, আমার স্বামীর স্বপ্ন ছিল বাড়িতে একটা ঘর বানাবে। আর ছেলেকে হাফেজি পড়াবে। কিন্তু স্বপ্ন আর পূরণ হলো না। এখন আমি কী করবো?
রাজীবের চাচা ইউসূফ আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার ভাতিজা আগে গ্রামের বাড়িতে ভাঙারির ব্যবসা করতো। এতে যে আয় হতো তাতে তাদের সংসার চালাতে পারতো না। তাই বাড়তি আয়ের আশায় পরে গাজীপুর বোর্ড বাজার এলাকায় ভাঙারির ব্যবসা শুরু করে। গত ২০ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে ভাঙারির গাড়ি নিয়ে রাস্তায় বের হলে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়।
তিনি আরও বলেন, আমি সরকারের কাছে অনুরোধ করি, তাকে শহীদদের তালিকাভুক্ত করা হোক। আর তাদের অভাবের সংসারে কিছু সহযোগিতা করতে সরকারের কাছে অনুরোধ জানাই।
তাদের প্রতিবেশী মমতাজ বেগম বলেন, রাজিব অনেক ভালো ছিল। তারা অনেক গরিব মানুষ। তার একটা ছেলে আছে। ছেলেটাকে সরকার যদি সাহায্য করে তার অনেক উপকার হবে।
স্থানীয় ৪নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য শহীদ উল্লাহ প্রধান বলেন, ছেলেটা একেবারে হতদরিদ্র পরিবারের সদস্য। তাদের কোনো জমি নেই। তাদের পরিবারিক করবস্থান না থাকায় অন্যদের কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। তার বাবা-মা দুইজনই ভিক্ষা করে জীবিকা নির্ভর করেন।
গজরা ইউপি চেয়ারম্যান শহীদ উল্লাহ বলেন, আমার জানামতে আরিফ একজন খুবই গরিব পরিবারের সন্তান। সে পরিবারসহ গাজীপুর থাকতো। তার একটি শিশু সন্তান রয়েছে। সে ভাঙারির ব্যবসা করতো। ছাত্র আন্দোলনের সময় দোকানে যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বের হয়। এ সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। তার এমন মৃত্যুতে আমরা শোকাহত। তাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলছি, নিহত আরিফ হোসেন রাজিবের পরিবারকে সাহায্য-সহযোগিতা কামনা করছি। সেইসঙ্গে আমার পরিষদ থেকেও তাকে সকল ধরনের সহযোগিতা করা হবে।
এমজেইউ