বিবাহবার্ষিকীর দিনে লাশ হয়ে ফিরলেন মিরাজুল
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে ১৬ ও ১৮ জুলাই সংঘাত-সংঘর্ষে উত্তপ্ত ছিল রংপুর মহানগর জুড়ে। কিন্তু ১৯ জুলাই (শুক্রবার) সকাল থেকেই শান্ত ছিল পুরো নগরী। হঠাৎ জুমার নামাজের পর বিকেল ৩টা থেকে মিছিল-স্লোগানে মুখরিত হয় রংপুর আবারও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।
এদিকে শুক্রবার সকালে মিরাজুল ইসলামের বাড়িতে চলছিল মুরগি ও পোলাওয়ের চাল রান্নার প্রস্তুতি। কারণে এদিন মিরাজুল-নাজমীম দম্পতির বিবাহবার্ষিকী। নিজেদের মতো করে দিনটি উদযাপনে অনেক পরিকল্পনা ছিল দুইজনের। কিন্তু একটা গুলি যেন তছনছ করে দিল এই দম্পতির সাজানো সংসার। বিবাহবার্ষিকীর দিনে নিথর মরদেহ হয়ে ফেরা স্বামীর কথা ভেবে এখনো অশ্রুসজল নাজমীম। শোকে স্তব্ধ অসহায় এ পরিবারের সদস্যরা এখন ভবিষ্যতের চিন্তায় দিশেহারা।
রংপুর নগরীর জুম্মাপাড়া এলাকার মৃত সামছুল ইসলামের ছেলে মিরাজুল ইসলাম (৩৫)। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। তিনি নগরীর সিটি বাজার এলাকায় পাইকারি ফলের (কলা) দোকানের কর্মচারী ছিলেন। স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে আড়াই শতক জমির ওপর টিনের চালের বাড়িতে বসবাস করতেন তিনি। মেরাজুলের তিন বছরের ছেলে হানিফ হোসেন এখনো বুঝে উঠতে পারেনি সে চিরতরে বাবার স্নেহ হারিয়েছে। আরেক ছেলে মেহরাব হোসেন নাজিল নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী।
অসময়ে স্বামীকে হারানো নাজমীম ইসলামের বিলাপ থামেনি এখনো। একজন নারীর কাছে বিবাহবার্ষিকীতে স্বামীর মৃত্যু কতটা কষ্ট ও বেদনার তা হয়তো নাজমীমের চেয়ে কেউ জানে না। তাই তো ওই দিনের ঘটনা প্রসঙ্গে জানতে চাইতেই কাঁদতে কাঁদতে নাজমীম ইসলাম বলেন, ‘অল্প আয়ের সংসার হলেও আমাদের মাঝে আনন্দের শেষ ছিল না। দুই ছেলেকে নিয়ে আমাদের সুখের সংসার। বড় ছেলেকে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু একটা গুলি আমার সাজানো সংসারটা তছনছ করে দিল। এখন আমি দুই সন্তান নিয়ে কোথায় যাব? কে চালাবে আমার সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি যদি স্বজন হারানোর বেদনা বুঝে থাকেন, তাহলে ১৩ দিনেও আমাদের খোঁজ নিলেন না কেন?
বুধবার (৩১ জুলাই) বিকেলে নিহত মিরাজুল ইসলামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, শোকে স্তব্ধ পুরো বাড়ি সুনসান। তার স্ত্রী নাজমীম ইসলাম বাড়ির উঠানে চুপচাপ বসে আছেন। ছোট ভাই হানিফকে কোলে নিয়ে বড় ভাই নাজিল। নাজিলও বাবার জন্য কাঁদছে। একপর্যায়ে বড় ভাইয়ের চোখের পানি হাত নিয়ে মুছে দিতে দেখা যায় শিশু হানিফকে।
পরিবার সূত্রে জানা যায়, ১৯ জুলাই শুক্রবার মিরাজুল ইসলামের বিবাহবার্ষিকী ছিল। সেদিন দুপুরে মুরগি, পোলাওয়ের চাল ও আলু নিয়ে বাড়ি যান। বিকেলে কলার দোকানের মহাজনকে টাকা দিতে মিরাজুল বাড়ি থেকে সিটি বাজারের দিকে যাচ্ছিলেন। বিকেল ৫টার দিকে দোকানের কাছাকাছি পৌঁছালে আন্দোলনকারী ও পুলিশের সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে যান। এ সময় গুলিবিদ্ধ হন মিরাজুল। স্থানীয় লোকজন তাকে উদ্ধার করে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে। কিছুক্ষণের মধ্যে তিনি মারা যান।
হাউমাউ করে কান্না করতে করতে নাজমীম ইসলাম বলেন, ‘ওনার স্বামীর মৃত্যুর আগের রাতে আমাদের বিবাহবার্ষিকী নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। দুপুরে বাজার থেকে মুরগি, পোলাওয়ের চাল ও আলু নিয়ে বাসায় আসেন। বিকেলে মহাজনকে টাকা দিতে বাসা থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় বলল, তুমি রান্না করো, আমি মহাজনকে দোকানে টাকাটা দিয়ে আসছি। রাতে একসঙ্গে খাবার খাব। কিন্তু তা আর হলো না। তিনি এলেন লাশ হয়ে।’
তিনি আরও বলেন, ‘দুই সন্তান ও শাশুড়িসহ পাঁচজনের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন মিরাজুল। বড় ছেলের লেখাপড়ার খরচসহ সংসার কীভাবে চলবে তা ভেবে পাচ্ছি না। এখনো সরকারের কোনো ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ আমাদের খোঁজখবর নেয়নি। স্বামী হত্যার প্রতিবাদে ওই দিন থেকে আমি এক কাপড়েই দিনযাপন করছি। কেউ তো আমাদের খোঁজ করল না। কার কাছে বিচার চাইব, আমরা নিরাপরাধ স্বামীকে গুলি করে হত্যার বিচার কী হবে?’
মিরাজুল গুলিবিদ্ধ হয়েছে এ খবর প্রথম জানতে পারেন তার বড় বোন রাবেয়া বেগম। খবর পাওয়ার পরই খালাকে নিয়ে ছুটে যান রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে গিয়ে অপারেশন থিয়েটারের বাইরে থাকা স্যান্ডেল দেখে নিশ্চিত হন তার ভাই ভেতরে আছেন। পরে কাছে যান এবং মুখে থাকা অক্সিজেন মাস্ক খুলে পুরোপুরি নিশ্চিত হন এটি তার ভাই মিরাজুলের মরদেহ। এ
হাসপাতালে ভর্তির পর চিকিৎসকরা অপারেশনের জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ আনতে বলেছিলেন। রাবেয়া ওষুধ কিনে আনার কিছুক্ষণ পর মিরাজুল বেঁচে নেই বলে জানান চিকিৎসকরা। পরে ওইদিন রাতেই জানাজা শেষে মিরাজুল ইসলামের দাফন সম্পন্ন করা হয়। মিরাজুলের বড় বোন রাবেয়া বেগম বলেন, ‘আমার ভাইয়ের পাঁজরে গুলি লাগে। কিন্তু কী অপরাধ ছিল তার যে গুলি করে হত্যা করতে হবে? তিনি তো কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না।’
মিরাজুলের মা আম্বিয়া বেগম বলেন, ‘তিন ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে মিরাজুল ছিল তৃতীয়। ছেলেমেয়েরা ছোট থাকতে স্বামীকে হারিয়েছি। অনেক কষ্ট করে আমাদের দিন যাচ্ছিল। যখন মিরাজুল বড় হয়ে সংসারের হাল ধরে তখন অনেকটা নিশ্চিন্ত ছিলাম। শুক্রবার সে মহাজনকে টাকা দিতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে মারা গেল। আমার নিরপরাধ ছেলের জীবনটা এভাবে চলে যাবে তা কখনো কল্পনা করিনি। ছেলের এমন মৃত্যুর জন্য প্রধানমন্ত্রী-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে বিচার দাবি করেন আম্বিয়া বেগম।
এদিকে মেরাজুলের কর্মস্থলের মহাজন জসিম উদ্দিন বলেন, ‘আমার বাবা অসুস্থ থাকায় দোকানের টাকা সেদিন না নিয়েই কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়েছিলাম। যার কারণে মিরাজুল বিকেলে টাকা দেওয়ার জন্য দোকানের দিকে আসছিল। তার সাথে আমার ফোনে কথাও হয়েছিল। কিন্তু ১০ মিনিট পর শুনি সে গুলিবিদ্ধ হয়েছে। এর কিছুক্ষণ পরই খবর আসে মিরাজুল হাসপাতালে মারা গেছেন। মিরাজুল অত্যন্ত ভালো মানুষ ছিল। সে আমার দোকানে কর্ম করলেও আমার বাল্যবন্ধু ছিল। তার এভাবে চলে যাওয়াটা বারবার আমার হৃদয়কে নাড়া দিচ্ছে।’
প্রসঙ্গত, গত ১৯ জুলাই রংপুর নগরীর বিভিন্ন এলাকায় কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ও দুষ্কৃতকারীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এদিন সংঘর্ষের সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে মিরাজুল ইসলামসহ চারজন নিহত হন।
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/আরকে