‘ছেলেকে ডাক্তার বানাতে সব খরচ করেছি, এখন কার কাছে বিচার চাইব’
কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে গত ১৮ জুলাই ঢাকার আজমপুরে মাদরাসা পড়ুয়া ছোট ভাইকে আনতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন নরসিংদীর রায়পুরার বাসিন্দা ডা. সজিব সরকার (৩১)। ওইদিন রাতেই উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে স্বজনরা নিহতের মরদেহ বাড়িতে নিয়ে আসে। পরদিন তার মরদেহ নিজ এলাকা চরসুবুদ্ধি স্থানীয় কবরস্থানে দাফন করা হয়।
ঘটনার সপ্তাহ পেরুলেও থামেনি নিহতের স্বজনদের শোক-আহাজারি। পরিবারে উপার্জনের একমাত্র অবলম্বন সজিবের মৃত্যুতে এখন কূল-কিনারাহীন সাগরে ভাসছে পুরো পরিবার।
নিহত ডা. সজিব সরকার রায়পুরা উপজেলার মির্জানগর ইউনিয়নের মেঝেরকান্দি গ্রামের মো হালিম সরকারের ছেলে। তিনি তিন ভাই এক বোনের মাঝে সবার বড় ছিলেন। তবে তিনি সপরিবারে জেলা সদরের ভেলানগরে জেলখানা মোড় এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া মেডিকেল কলেজের লেকচারার ছিলেন। পাশাপাশি বেলাবো উপজেলার নারায়ণপুরে কেয়ার নামক একটি বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতালে রোগীদের সেবা দিতেন।
ডা. সজিবের ছোট বোন সুমাইয়া সরকার স্বর্ণা বলেন, গত ১৮ জুলাই দুপুরে ঢাকার উত্তরার রাজলক্ষ্মীর একটি কওমি মাদরাসা পড়ুয়া ছোট ভাই আব্দুল্লাহকে আনতে নরসিংদীর বাসা থেকে ঢাকার উদ্দেশ্য বের হন সজিব ভাইয়া। পরে খবর পেয়েছি, তুমুল আন্দোলনের সময় আজমপুরে গিয়ে বাস থামে। বিকেল ৫টা-৬টার মধ্যে আজমপুরে বাস থেকে নেমে রাজলক্ষ্মী মাদরাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে রাস্তার পাশ ধরে হাঁটতে থাকেন তিনি। এ সময় পুলিশের ছোড়া গুলিতে তিনি নিহত হন। সেসময় কয়েকজন লোক গুলিবিদ্ধ ভাইকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। পরে ভাইয়ের বন্ধুর মাধ্যমে ভাইয়ের মৃত্যুর খবর পাই। পরে স্বজনরা উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মরদেহ খুঁজে পেয়ে বাড়িতে নিয়ে আসেন। আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কাছে আমার ভাইকে যারা হত্যা করেছে তাদের চিহ্নিত করে শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।
নিহত ডা. সজিবের বাবা মো. হালিম সরকার বলেন, কী অপরাধ ছিল আমার ছেলের? সে তো আন্দোলনে যায়নি? তুবও কেন গুলিতে আমার ছেলের বুক ঝাঁঝরা হলো? এখন আমি কার কাছে বিচার চাইব? কে দেবে আমার ক্ষতিপূরণ? যা সহায় সম্বল কামাই ছিল সব ছেলেকে ডাক্তার বানাতে খরচ করেছি। নিজের সহায় সম্বল শেষ করে পরে বিভিন্ন জায়গা থেকে ঋণ নিয়ে ছেলেকে ডাক্তার বানাই। স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হয়ে দেশ ও জাতির কল্যাণে সে কাজ করবে। আর এখন এ দেশ ও জাতি আমাকে আমার সেই ছেলের লাশ উপহার দিল। ছেলে আমার পরিবারের ছায়া ছিল, এখন আমার সব শেষ।
আরও পড়ুন
তিনি আরও বলেন, ছেলেকে খুব কষ্ট করে ঢাকার উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে পঞ্চম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করাই। ২০২০ সালে টঙ্গীর গাজীপুর বেসরকারি তাইরুন্নেছা মেমোরিয়াল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে ডিগ্রি নিয়ে সে ডাক্তার হয়। তাকে চিকিৎসক বানাতে গিয়ে পুরো পরিবার ঋণে জর্জরিত। বেশকিছু দিন হলো সে ঋণগ্রস্ত পরিবারের হাল ধরে। আত্মীয় স্বজনদের ঋণ কিছু কিছু করে শোধ করতেছিলাম। এখনো তার একমাত্র উপার্জনে অসুস্থ মায়ের চিকিৎসা ও ভাই-বোনের পড়াশোনা এবং সংসার চলার পাশাপাশি শোধ হচ্ছিল ঋণ। এখনো প্রাইম ব্যাংক আমার কাছ থেকে তিন লাখ টাকা পায়। সেই টাকাও পরিশোধ করতে পারিনি। সব লোন শোধ করার পর আমাদের নিয়ে কতোই না স্বপ্ন ছিল তার। তাদের একটি গুলি এখন আমার, আমার ছেলে এবং আমার পুরো পরিবারের স্বপ্ন ধ্বংস করে দিল। আমরা আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান। আমার দুই ভাই মুক্তিযোদ্ধা। আমি নিজে টঙ্গীতে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে চাকরি করছি। আমার ছেলে সজিব ইন্টার্ন করা অবস্থায়ও আর্থিক সাহায্য করে সংসার চালাতো। এখন আমি কি করে একা এ সংসার চালিয়ে ঋণ পরিশোধ করব মাথায় আসছে না।
হালিম সরকার বলেন, আমার ছেলেতো নির্দোষ, সেতো কোনো দলের ছিল না। আমি রাষ্ট্রের কাছে আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই। রাষ্ট্র যদি তদন্ত করে ছেলে হত্যার বিচারটা করে, তাইলেই তার আত্মা ও আমরা শান্তি পাব।
চিকিৎসক ছেলেকে হারিয়ে মা ঝর্ণা বেগমও বেশ অসুস্থ। প্রতিদিন অক্সিজেন নিয়ে বেঁচে আছেন তিনি। প্রায় প্রতিদিনই ছেলের স্মৃতিচারণ করে বিলাপ করে অশ্রু ঝরাচ্ছেন। তবে এতো কিছুর পরও একটাই চাওয়া ছেলে হত্যার বিচার যেন দেখে যেতে পারেন তিনি।
স্থানীয় বাসিন্দা নজরুল ইসলাম বলেন, সজিব সময় পেলেই এলাকায় এসে বিনামূল্যে মানুষের চিকিৎসাসেবা দিতেন। তার মৃত্যু মেনে নেওয়ার মতো নয়। খুব ভালো মনের পরহেজগার মানুষ ছিলেন। তার পরিবার ও স্বজনদের কাছ থেকে যতদূর শুনেছি, বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই) পুলিশের গুলিতে নিহত হয়ে রাতে মরদেহ বাড়িতে নিয়ে আসে। পরে শুক্রবার (১৯ জুলাই) জুমার নামাজের আগে জানাযা শেষে স্থানীয় চরসুবুদ্ধি কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। আল্লাহ তার পরিবারকে শোক সইবার শক্তি প্রদান করুন।
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইকবাল হাসান বলেন, এ রকম কোনো খবর আমরা এখনো পাইনি বা আমাদেরকে কেউ জানায়নি।
তন্ময় সাহা/আরএআর