‘অত্তটুকু পোলারে গুল্লি মাইররা মাথা ফুটা কইরা দিছে’
গ্রামের বাড়িতে মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল না। ছিল না কাজের সংস্থানও। সর্বশেষ ঘূর্ণিঝড় রিমাল ভেঙে রেখে গেছে দোচালা টিনের ঘরটি। ইচ্ছা ছিল পরিবারের সকলের আয় মিলিয়ে এবার ঘরটি মেরামত করবে। মা কুলসুম বিবি ও বাবা নান্টু কাজি ১৪ বছরের ছোট ছেলে ইমনকে রিকশা কিনে দিয়েছিল। অলিগলিতে চালিয়ে ভালোই রোজগার করতো ইমন। কিন্তু কে জানতো ইমনের রোজগারের টাকায় ঘর মেরামত না করে তার দাফনে খরচ করতে হবে।
ভাঙা ঘরের অদূরে কালো পলিথিনে জড়ানো উঁচু ঢিবিতে ইমনের কবরের কাছেই থাকেন আর সারাক্ষণ বিলাপ করেন কুলসুম বিবি।
‘আমার পোলারে লইয়্যা গ্যাছে, আমার জানডা কেউ কবজ করে না ক্যা? অত্তটুকু পোলারে গুল্লি মাইররা মাথা ফুটা কইরা দিছে। এ্যাই বিচার কার ধারে দিমু? য্যারা মারছে হ্যাগোরে মুই মাফ করমু না।’ বলতে বলতেই কবর জড়িয়ে ধরেন তিনি।
ভোলা সদর উপজেলার আলীনগর ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের সাচিয়া গ্রামের কাজি বাড়িতে গিয়ে এমন দৃশ্য দেখা গেছে।
বাড়ির লোকজন জানান, প্রবল অর্থকষ্টের কারণে ৮ বছর আগে ঢাকায় পাড়ি জমান কুলসুম-নান্টু দম্পতি। থাকতেন রাজধানীর উত্তর বাড্ডার জামতলা এলাকায়। সংসারে তিন ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলেদের মধ্যে সবার ছোট ইমন। কুলসুম পোশাক কারখানায় আর নান্টু দিনমজুরির কাজ করতেন। অন্য সন্তানরাও রিকশা-ভ্যান চালাতেন। সকলের সমন্বিত টাকায়ও সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হতো।
কুলসুম জানান, কারফিউ ঘোষণা দিলে অনেক আতঙ্ক ছড়ায়। তারপরও কেউ কেউ রাস্তায় নামতো। শনিবার (২০ জুলাই) দুপুরে নিজেই ভাত বেড়ে খাইয়েছেন ছেলে ইমনকে। বিকেল ৪টার দিকে জামতলা এলাকার গলিতে রিকশা নিয়ে বের হয়। সাড়ে ৪টার দিকে এলাকার মানুষ খবর দেয় ইমন গুলিবিদ্ধ হয়েছে।
আরও পড়ুন
তিনি বলেন, ‘খবর হইন্যা দৌড়াইতে দৌড়াইতে জামতলা গলির ধারে যাই। যাইয়া হুনি হাসপতালে নিছে। গেলাম হাসপাতালে। অনেক খোঁজার পরে পাইলাম আমার বাজানের লাশ। থুতনি দিয়ে ঢুকে মাথা ফুডা হইয়্যা গ্যাছে। আমরা অভাবি মানুষ। আমার পোলাডার কোনো অপরাধ আছিল না। আমিতো আর বুঝি নাই আমার বাজান হেইদিন মোর হাতে শ্যাষ খাওন খাইছে।’
‘রেমাল নিলো ঘরবাড়ি, গুলি নিলো মোর বাজানরে’ ডুকরে কাঁদতে কাঁদতে মুর্ছা যান কুলসুম। বলেন, ‘আমাগোতো কেউ নাই। আমার পোলায়তো মিছিলেও যায় নাই। আমরা প্যাটখিদার (পেটের ক্ষুধা) মানুষ। ঘরের খোড়াকি (রোজগার) জোগাইতে পোলায় রাস্তায় নামছিল। কার্ফুর স্যারেরা আইয়্যা গুল্লি মাইরা দিলো। এট্টু বাদবিচারও করল না, রিকশায়ালা মারতাছে ক্যান?
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, রাস্তায় নামলে অন্যরাও গুলিবিদ্ধ হতে পারে এই ভয়ে পুরুষ মানুষ সঙ্গে আনেননি কুলসুম। ছেলের লাশ নিয়ে নিজেই এসেছেন গ্রামের বাড়িতে। প্রতিবেশীরা অনেক চেষ্টা করেও দানাপানি দিতে পারেননি তার মুখে।
স্থানীয় ইউনুস বেপারী বলেন, আমাদের গ্রামের বাসিন্দা ইমন। ঢাকায় গুলিতে মারা গেছে। বাড়িতে এনে দাফনের আগে ও পরে পুলিশ এসে খোঁজখবর নিয়ে গেছে।
আলীনগর ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য শাজাহান বলেন, ইমনকে আমি চিনতাম। অভাবের কারণে ওরা ঢাকায় থাকতো। মাঝেমধ্যে এলাকায় আসতো। গত রোববার ওর মা ইমনের গুলিবিদ্ধ মরদেহ নিয়ে এসেছে। দরিদ্র পরিবার এত বড় ধাক্কা ওরা সইতে পারবে বলে মনে হয় না।
তিনি বলেন, ওদেরতো খুব বেশি জমি নেই। ঘরের চারপাশে যা আছে তাতেই দাফন করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ঢাকায় সহিংসতার গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহতদের মধ্যে ইমন একজন। স্থানীয়ভাবে জানা গেছে, ঢাকায় নিহতদের মধ্যে ১৮ জনের বাড়ি ভোলার বিভিন্ন উপজেলায়।
আরএআর