চাঁপাইনবাবগঞ্জে আম চাষীদের মাথায় হাত, ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন
ছাত্র আন্দোলন ও কয়েকদিনের কারফিউ পরিস্থিতির মুখে পড়েছিলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম ব্যবসায়ীরা। এতে প্রায় ১০০ কোটি টাকা ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে বলে দাবি তাদের।
চলমান পরিস্থিতিতে বাজারজাত করতে না পারার কারণে বিপুল পরিমাণ আম গাছেই নষ্ট হয়ে গেছে এবং কেউ কেউ আবার স্থানীয় বাজারে কম দামেও বিক্রি করেছেন।
সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, আমের রাজধানী খ্যাত চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিভিন্ন বাগানে ফজলি, আশ্বিনা, কাটিমন, বারি-৪সহ নানা জাতের আম গাছে ঝুলছে। বাগানগুলোতে ব্যস্ত সময় পার করছেন আম চাষী ও তাদের সহকর্মীরা।
এছাড়া কয়েকদিন আগে কারফিউর কারণে, অনলাইনে (ফেসবুক মার্কেটিং-এ) আম বিক্রি বন্ধ, যানবাহনের সংকট, বাজারগুলোতে ক্রেতা কম আসায় আম বিক্রি করতে হিমশিম খেতে হয়েছে চাষীদের। বরং আম পেকে নষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় মণে ১০০০ থেকে ১২০০ টাকা কমে আম বিক্রি করেছেন তারা। তবে বর্তমানে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ায় আমের বাজারগুলো আবারও জমতে শুরু করেছে।
আম চাষী আকবর আলী বলেন, কারফিউয়ের কারণে আমাদের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আম ভাঙ্গতে পারিনি। বাজারে আম নিয়ে এসে তো বিক্রি করতে হবে, ক্রেতা না থাকলে তো আর বিক্রি করতে পারছি না। এজন্য আমাদের কিছু লস হয়েছে। আমরা সরকারের কাছে সবিনয় অনুরোধ করছি যেন দেশের পরিস্থিতিটা স্বাভাবিক করে। যাতে আমরা ভালো ভাবে ব্যাবসা বাণিজ্য করে চলতে পারি।
আম ব্যাপারী রেজাউল করিম বলেন, দেশের বিভিন্ন জায়গায় আমরা আম পাঠাই। দেশের যে অবস্থা ব্যাংকে টাকা থেকে টাকা তুলতে পারছি না। তার কারণে মাল (পণ্য) কিনে টাকা দিতে পারছি না। মাল কিনে যে রাস্তাঘাটে ছাড়বো তার কোন নিরাপত্তা নাই। দোকান পাট বন্ধ থাকার কারণে মালগুলো বিক্রি করতে পারছি না। সরকারের কাছে আহ্বান জানাচ্ছি যেন দেশটা শান্তিতে চলে। মানুষজন যেন কাজকর্ম করে খেতে পারে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক, আম চাষী ও বরেন্দ কৃষি উদ্যোগের উদ্যোক্তা মনজের আলম মানিক বলেন, কোটা আন্দোলনের কারণে দেশে অরাজকতার সৃষ্টি হয়েছিল। তার কারণে আজ অব্দি ফেসবুক বন্ধ আছে। এই প্লাটফর্মের কারণে আমরা সরাসরি আম বিক্রি করতে পারি কাস্টমারের কাছে। এটি একেবারে অফ থাকার কারণে আমরা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছি। গত কয়েকদিনে আম বাজারজাতকরণ, পরিবহন ব্যবস্থা না থাকা, ক্রেতা সংকটের কারণে আমাদের ৪০ শতাংশ আমের লস হয়েছে। এখন কোনও আম পাকতে আর বাকি নেই। এই কারণে পাকা আমগুলো ঝরে ঝরে পড়েছে এবং লেবারদেরকে মজুরি দিতে না পারায় ১০-১৫ কেজি আম তাদেরকে দিয়েছি মাত্র ২০ টাকা কেজিতে। যেখানে এইবছর আমাদের আমের পরিমাণ খুবই কম এবং বাজার মূল্য পাওয়াটায় বড় ব্যাপার ছিল, সেখানে এই ক্ষতি আমরা কিভাবে পোষাবো?
তিনি আরও বলেন, কৃষি ক্ষেত্রেই শুধু কৃষকেরা লস করে। খুব আশ্চর্যজনক ব্যাপার কৃষি বিভাগ এই সময় চাষীদের খোঁজ খবর নিচ্ছে না। তাছাড়া চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রতিদিন আম বিক্রি হয় ২৫ থেকে ৩০ কোটি টাকার। আর গত কয়েকদিনে ২৫০ থেকে ৩০০ কোটি টাকার ব্যবসা হয়নি তাতে আমাদের ৪০ ভাগ লস হয়েছে। অন্যান্য সেক্টরে লস করলে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয়। কিন্ত কৃষকদেরকে কোনও কিছুই দেওয়া হয় না। নীতিনির্ধারকেরা যদি কোনও ব্যবস্থা নেন বা আমাদের সাথে কথা বলেন তাহলে আমাদের বিষয়গুলো আমরা তুলে ধরতে পারব।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ ম্যাংগো ফাউন্ডেশনের সদস্য সচিব ও আম চাষী আহসান হাবীব বলেন, নানান অঘটনের কারণে গত সপ্তাহে প্রায় তিনদিন আমরা আম বিক্রি করতে পারিনি। পরিবহন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, ট্রাক ভাড়া বেশি ছিল, আম পাঠাতে অনেকে পারতো না। কেনার পর আড়ৎদারদের আম পঁচে নষ্ট হয়ে গেছে। গত সপ্তাহে প্রতি মণ আম এক থেকে দেড় হাজার টাকা রেট কমে গিয়েছিল। গত বুধবার থেকে আম আগের রেটে ফিরে এসেছে। সারাদেশে কুরিয়ার সার্ভিসে, অনলাইনে যে আমগুলো সরবরাহ করা হতো সেই আম যাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তার কারণে গত সপ্তাহের রোববার থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত কানসাট আম বাজার থেকে যেখানে ১০০ ট্রাক আম যেত সেখানে আম গিয়েছে মাত্র ২৫ থেকে ৩০ ট্রাক। যার কারণে তিনভাগ আম সরবরাহ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এতে করে প্রায় শতকোটি টাকা ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিলাম।
তিনি আরও বলেন, সামনের দিনে আবারও অঘটন ঘটতে থাকলে আমরা আম চাষীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবো। তাই আমাদের আবেদন, আমাদের চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম চাষীদের দিকে লক্ষ্য রেখে যে অঘটনগুলো কয়েকদিনে ঘটেছে এমন ঘটনা যেন আর কেউ না ঘটায়। সরকার, রাজনৈতিক দল ও প্রত্যেকটি মানুষের কাছে আমাদের এই প্রত্যাশা।
আরও পড়ুন
চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক পলাশ সরকার বলেন, ছাত্র আন্দোলন ও কারফিউয়ের কারণে আম চাষীদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আমার জানা নেই। তবে এই কয়েকদিনে খুব একটা বেশি তাদের ক্ষতি হয়নি বলে আমি ধারণা করি।
অবশ্য কারফিউয়ের কয়েকদিন আম চাষীরা মণ প্রতি ৩শ থেকে ৪শ টাকা কমে আম বিক্রি করেছেন বলেও জানান তিনি।
আশিক আলী/টিএম